ধর্ষিতা বাদিনীকে এবার ওসির কুপ্রস্তাব, অত:পর…
নিজের ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে এমনই বিপদের মুখে পড়েন চট্টগ্রামের এক তরুণী। প্রতারক প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছিলেন তিনি। তার তদন্তভার বর্তায় যার ওপর, একসময় সেই পুলিশ কর্মকর্তারই লোলুপ দৃষ্টির শিকার হতে হয় তাকে। মামলা তদন্তের ছুতায় রক্ষকের বদলে ভক্ষকের আচরণ শুরু করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ওই পুলিশের নামেও আদালতে মামলা করতে বাধ্য হয়েছেন ভুক্তভোগী ওই তরুণী। এ বিষয়ে বিস্তারিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অন্তঃসত্ত্বা করে পালিয়ে যাওয়া প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করে আদালতে বিচারপ্রার্থী হন এ তরুণী। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার ওসি (তদন্ত) ওমর ফারুক। কিন্তু একপর্যায়ে এ বিচারপ্রার্থী তরুণীর ওপর কুনজর পড়ে ওসির। বাদিনীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলার নানা চেষ্টা চালাতে থাকেন তিনি। তবে সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষোভে শেষ অবধি বাদিনীর বিরুদ্ধেই তদন্ত প্রতিবেদন দেন তিনি। রিপোর্টে ওসি উল্লেখ করেন, বাদিনীকে ধর্ষণ করা হয়নি। তিনি একজন খারাপ চরিত্রের নারী। আসামিকে ঘরে ডেকে নিয়ে নিজেই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন।
প্রেমের প্রলোভনে ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া এবং মামলা দায়েরের পর গর্ভপাত ঘটানোর ডাক্তারি সনদসহ সব তথ্য-প্রমাণ হাজির করার পরও ওসির এমন প্রতিবেদনে বিমূঢ় হয়ে যান বাদিনী। তবে ওসির প্রকৃত মনোভাব আঁচ করতে পেরে তিনিও সতর্ক ছিলেন শুরু থেকেই। তাই তার সঙ্গে মোবাইল ফোনের কথোপকথন, কুপ্রস্তাব দেয়া, মামলার তদন্ত রিপোর্ট পক্ষে দেয়ার টোপ দিয়ে সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ছবিসহ সব প্রমাণ সংগ্রহ করেন তিনি। এরপর সেগুলো উপস্থাপন করে আদালতে ওসির বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেন। আদালত ওসির বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ঘটনা পুলিশ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর আদালতে ১১ অক্টোবর ওসি ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(৪)(খ) ধারায় এ মামলা (নম্বর ১২৬৫/১৫) করা হয়। আদালতের বিচারক মামলার গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে শুনানির জন্য ২৭ অক্টোবর তারিখ ধার্য করেন।
জানা গেছে, বোয়ালখালী উপজেলার পশ্চিম গোমদণ্ডী এলাকার বাসিন্দা ২৪ বছর বয়সী এক তরুণীর সঙ্গে একই উপজেলার খরণদ্বীপ ইউনিয়নের বাসিন্দা হাবিবুল ইসলামের ছেলে ইফতেখারুল ইসলাম সানি (৩০) প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। প্রায় এক বছর ধরে এ সম্পর্ক থাকাকালে ওই তরুণীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে তরুণীটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এরপর ওই তরুণী সানিকে বিয়ের জন্য চাপ দেন। কাবিননামা সম্পাদন করতে বলেন। সানি নানাভাবে বিষয়টি পাশ কাটিয়ে একপর্যায়ে বিদেশে পাড়ি জমান। নিরুপায় হয়ে আদালতের আশ্রয় নেন ওই তরুণী। ১০ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন আদালত-১-এ সানির বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। আদালত মামলা আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পড়ে বোয়ালখালী থানার ওসি (তদন্ত) ওমর ফারুকের ওপর।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তদন্তের প্রয়োজনে ওসি বাদিনীকে একাধিকবার থানায় ডেকে পাঠান। বাদিনীর বাড়িতেও যান তিনি। একপর্যায়ে ওই তরুণীর ওপর কুনজর পড়ে ওসির। তদন্তের বাহানায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাদিনীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। রাত-বিরাতে যখন-তখন কথা বলে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা চালান। কখনও গান শুনিয়ে, কখনও নানা মধুর সম্বোধনে ওই তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেন।
ওসি ওমর ফারুকের সঙ্গে বাদিনীর মোবাইল ফোনের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ৭ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় তিনি ফোন করেন। কথা বলেন ৫৯ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড। ওই রেকর্ডের ২৬তম মিনিটের দিকে ওমর ফারুক বলেন, ‘… তুমি আমাকে টাকা দিবা বলছ, … তুমি কী আমাকে ভালোবাসা দিবা না? আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাই না। আমি এটা চাই। আমাকে তোমার টাকা দিতে হবে না, আমি ওটা চাই…। তুমি বন্ধু কথা দাও …। আমি কি আশা করতে পারি …। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। … তুমি বন্ধু আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখ না প্লিজ …।’
পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১২টায় করা ১৮ মিনিটের মোবাইল ফোনের রেকর্ডের প্রথম মিনিটে শোনা যায়, ওসি বলছেন, ‘তুমি ক্লিয়ার হয়ে যাও (গর্ভপাত করে ফেল)।’ শেষদিকে ওসি বলেন, ‘বন্ধু সর্বোপরি কথা হচ্ছে, তুমি আমার প্রস্তাব ভেবে দেখ, আমাকে কথা দাও, তুমি আমাকে নিরাশ করবা না…। আমি কিন্তু অনেক ধৈর্য ধরেছি। তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগছে। তাই এ কথা বলা…। আমাকে হতাশ করবা না। নিরাশ করবা না,… আমি তোমাকে মন থেকে চাচ্ছি।’ অপর একটি রেকর্ডে দেখা যায়, ওসির প্রস্তাবের বিষয়ে বাদিনী বলছেন, ‘আমি ভেবে দেখি। আগে মামলার রিপোর্টটা দেন।’ উত্তরে ওসি বলেন, ‘মামলা হাতে থাকতেই আমি তোমাকে চাই।’ ওসির সঙ্গে বাদিনীর কথোপকথনের এসব রেকর্ড ও ছবি সংরক্ষিত আছে। তা থেকে জানা গেছে, এরই মধ্যে ওসি বাদিনীর মামলার তদন্ত রিপোর্ট চাওয়ার দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকতে এবং পতেঙ্গার নেভাল বিচে নিয়ে যান। সেখানে অন্তঃরঙ্গ ছবি তুলতেও বাধ্য করেন।
বাদিনী ও সংশ্লিষ্ট সূত্র অভিযোগ করেছে, অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাদিনীর কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে ওমর ফারুক ধর্ষক প্রেমিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত রিপোর্ট বাদিনীর বিপক্ষে দেন। ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে দেয়া ওই প্রতিবেদনে ওমর ফারুক উল্লেখ করেন, ‘বাদিনীর সহিত ভিকটিমের প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক হেতু বাদিনী বিবাদী সানির সহিত অবৈধ যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে। তবে জোরপূর্বক ধর্ষণ ও অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কোনরূপ সত্যতা পাওয়া যায় নাই। সার্বিক পর্যালোচনায় বাদিনীর দায়েরকৃত অভিযোগটি উদ্দেশ্যমূলক ও হয়রানিমূলক বলিয়া প্রতীয়মান হয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. করিমুন নেহারের দেয়া রিপোর্টে ওই তরুণীকে ধর্ষণের আলামত পাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। একই সঙ্গে অপর একটি রিপোর্টে বাদিনীর গর্ভপাতের বিষয়টিও স্পষ্ট। অন্যদিকে ধর্ষণ মামলার আসামি ইফতেখারুল ইসলাম সানি (পাসপোর্ট নম্বর : বিই-০২২১২৪৭) বিগত ১০ আগস্ট মধ্যপ্রাচ্যে গমন করে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ আছে।
বাদিনী অভিযোগ করেন, প্রেমের অভিনয় করে তাকে ধর্ষণ করে সানি। শেষ পর্যন্ত বিয়ে না করে পালিয়ে যাওয়ায় তিনি তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন ন্যায়বিচার পেতে। কিন্তু বিচার চাইতে গিয়ে তিনি আবারও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বোয়ালখালী থানার ওসি (তদন্ত) ওমর ফারুকের (বিপি-৭৫৯৯০২৮৭৩১) কুনজরে পড়েন। তাকে ভোগ করতে চেয়ে না পেরে সানির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় মিথ্যা ও অসত্য তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে তাকে (বাদিনীকে) ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছেন। তাই বাদিনী ওসি ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। তিনি বলেন, ‘একবার ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে আবারও ধর্ষণের শিকার হব এমন তো হতে পারে না।’
ওসি ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে বাদিনীর পক্ষে মামলা দায়েরকারী আইনজীবী রেজাউল করিম রনি বৃহস্পতিবার বলেন, ‘যারা মানুষের নিরাপত্তা দেবেন, তারাই যদি কাউকে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লালসার শিকার বানাতে চান তাহলে বিচার কোথায় পাওয়া যাবে? আদালত মামলা দায়েরের পর প্রথমে সিজেএমকে তদন্তের নির্দেশ দেন বলে জানতে পারি। পরে জানতে পেরেছি, এ মামলাটির গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আগামী ২৭ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেছেন।’
বাদিনীকে ধর্ষণচেষ্টা ও অসত্য তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে ওমর ফারুক বৃহস্পতিবার বলেন, ‘তদন্ত করে যা পেয়েছি তার ভিত্তিতেই রিপোর্ট দিয়েছি। আমার মনে হয়েছে রিপোর্ট মেয়েটির পক্ষেই গেছে। এর পরও মেয়েটি আমাকে ভুল বুঝেছে। আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। নানা অভিযোগ করছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা মামলা সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করব না। কারণ আদালত মামলাটি বিচারিক তদন্তে দিয়েছেন।’ মোবাইল ফোনে বাদিনীকে কুপ্রস্তাব দেয়া, বেড়াতে যাওয়ার রেকর্ড হাতে থাকার কথা জানানোর পর ওমর ফারুক এ বিষয়ে বাকি সব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান।
ওসির বিরুদ্ধে মামলার বাদিনীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘যেহেতু বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে তাই আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ীই পদক্ষেপ নেয়া হবে।’