দশ বছর ধরে প্রেম, জানতেই দেননি শ্রেয়া
দশ বছর আগে যেদিন তাঁর হবু স্বামীর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল, কাকতালীয় ভাবে সেই তারিখেই বিয়ে করলেন তিনি!
৫ ফেব্রুয়ারি। সন্ধেবেলা। বান্দ্রা কুর্লা কমপ্লেক্স-এর এক ফরাসি হোটেল চেন-এর বলরুম। কনের পরনে লাল বেনারসি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনার জড়োয়া সেট। পাত্র পোশাক নিয়ে একটু খুঁতখুঁতে। পাঞ্জাবি পছন্দ না হওয়াতে কলকাতা থেকে পাল্টে অন্য একটা আনিয়েছেন!
কোনও রিয়েলিটি শো-এর শু্যটিং নয়। বলিউডি চিত্রনাট্যও নয়। সাত পাকে বাঁধা, সিঁদুর দান সব নিয়ম মেনে বিয়ে করলেন শ্রেয়া ঘোষাল। পাত্র শিলাদিত্য মুখোপাধ্যায়। মুম্বইনিবাসী। পেশায় ব্যবসায়ী। ‘রেজিল্যান্ট টেক’-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। হিপক্যাস্ক আর পয়েন্টেশেলফ্ বলে দু’টো অ্যাপ তৈরির কোম্পানির সঙ্গেও যুক্ত।
বছর দশেক ধরেই শ্রেয়ার আলাপ শিলাদিত্যর সঙ্গে। ‘‘আমি যখন মুম্বইতে এসেছি, তখন থেকেই তো শিলাদিত্যকে চিনি। জানতাম শ্রেয়ার জীবনে ও খুব স্পেশাল। একসঙ্গে কলেজে পড়ত দু’জনে। শ্রেয়া তখনও এত সাফল্য পায়নি। সে সময় থেকেই ওদের প্রেম। ওদের বোঝাপড়াটাও খুব ভাল,’’ বলছেন সুরকার শান্তনু মৈত্র।
এত বছরের প্রেম। কিন্তু মিডিয়াতে কোনও দিন একটা শব্দও বলেননি কেন? ‘‘শ্রেয়া মানুষটাই অন্য রকম। তাই কাউকে কিছু বলেননি। আমরাও যারা ব্যাপারটা জানতাম, কিছু বলিনি। তবে এক সময় আমি ওদের বলেছিলাম অনেক তো হল, এ বার বিয়েটা করে ফেলো। আমার মনে হয় এক বছর আগে থেকেই ওরা বিয়ের দিনটা ঠিক করে ফেলেছিল,’’ বলেন শান্তনু।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির হেন পরিচালক নেই যাঁর ছবিতে শ্রেয়া গান করেননি। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেন একমাত্র তিন বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক। মুম্বই থেকে বিয়েবাড়িতে পৌঁছলেন সস্ত্রীক শান্তনু আর জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে উড়ে গেলেন সঙ্গীত পরিচালক জয় সরকার। বলিউডে এত সেলিব্রিটির ভিড়েও মাত্র তিন জন সুরকারকে কেন বেছে নিলেন শ্রেয়া? উত্তরে জয় বলছেন, ‘‘সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের জোরেই শ্রেয়া আমাদের ডেকেছেন। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় ১৯৯৯ থেকে। শ্রেয়াকে বিয়েতে একটা ঘড়ি দিলাম। শিলাদিত্যকে একটা কলম।’’ জিৎ বলছেন, “দু’বছর আগে শ্রেয়া ওর ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে ঘনিষ্ঠদের ডেকেছিল। ওই অনুষ্ঠানেও শিলাদিত্য এসেছিল। দু’জনকে একসঙ্গে মানিয়েছে দারুণ। ওদের ঘড়ি উপহার দিলাম।’’
এই গোপনীয়তাই কি সেলিব্রিটি বিয়ের নতুন ট্রেন্ড? বিদ্যা বালনের বিয়ের সময় রেখা ছাড়া আর তেমন কোনও কেউকেটা আমন্ত্রণ পাননি। জন আব্রাহাম তো সুদূর আমেরিকাতে গিয়ে বিয়ে করে তারপর খবরটা টুইটারে ফাঁস করেছিলেন। রানি মুখোপাধ্যায়ও কম যান না। ইতালিতে গিয়ে আদিত্য চোপড়ার সঙ্গে বিয়েটা সেরে ফেললেন। কর্ণ জোহর আর বৈভবী মার্চেন্ট ছাড়া কাউকেই দেখা যায়নি সেই বিয়েতে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দিয়া মির্জা আর সোহা আলি খানের বিয়েতেও। এমনকী টলিউডের সুদীপ্তা চক্রবর্তীও নিজের বিয়ের খবর জানিয়েছিলেন ফেসবুকে। গোপনীয়তা রেখে ঘনিষ্ঠদের সামনে বিয়ে করার রেওয়াজে নতুন সংযোজন শ্রেয়া।
এঁদের সবারই একটাই ইচ্ছে। মূল অনুষ্ঠান থেকে যেন নজরটা না সরে যায়। পেশার খাতিরে লাইমলাইটে ঝলসে যেতে অভ্যস্ত এঁরা। কিন্তু জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটিকে তাঁরা পর্দানশিন করে রাখতে চান। আত্মীয়স্বজন আর পেশাগত জীবনের হাতে গোনা কিছু মানুষ ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার থাকে না। কেউ কেউ বিয়ের পরে গোটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা রিসেপশন দিয়ে থাকেন। যেমনটা হয়তো করবেন শ্রেয়াও।
৩০ জানুয়ারি শ্রেয়া অবশ্য একটা হাল্কা আভাস দিয়েছিলেন ফেসবুকে। লিখেছিলেন, “জানি না, আমি সুপার-নার্ভাস না সুপার-এক্সাইটেড। এ রকম এর আগে কোনও দিন অনুভব করিনি। কী করতে চলেছি, তা আপনাদের পরে জানাব। আপনাদের শুভেচ্ছা চাই…।’’ সাত পাক ঘুরে শুক্রবার টুইটারে খবরটা দিলেন নিজেই। সঙ্গে বিয়ের ছবি।
বাঙালি মতে মন্ত্র পড়ে বিয়ে। শ্রেয়ার বাবা-মা-ভাই ছাড়াও অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তাঁর দিদিমা-কাকা-জ্যাঠা-মামা-মামি। ছিলেন ঘোষাল পরিবারের বন্ধুবান্ধব। ছিমছাম অনুষ্ঠান। কোনও বলিউডি আদবকায়দা নেই সেখানে। এমনকী যে শ্রেয়ার কণ্ঠে বলিউড মেতেছে রোম্যান্টিক গানে, তাঁর বিয়েতে বাজেনি ফিল্মি গান। শোনা যায়নি ‘ডোলা রে’ কিংবা ‘জাদু হ্যায় নশা হ্যায়’ বা ‘যাও পাখি’। বাসর ঘরে বাজেনি ‘ও সাথিয়া’। শুধু উলুধ্বনি, শঙ্খে ফুঁ, সানাইয়ের মায়াবী সুর।
কিন্তু শ্রেয়া থাকলে সঙ্গীতের ছায়াকে কি একেবারে অস্বীকার করা সম্ভব? বিয়ের আগে শ্রেয়াকে বসানো হয়েছিল একটা ঘরে। অন্য ঘরে ছিলেন শিলাদিত্য। কিন্তু বিয়ের মণ্ডপে নিয়ে যাওয়ার আগে বেশ খানিকটা অপেক্ষা করতে হচ্ছিল শ্রেয়াকে। ইয়ার্কি করে শ্রেয়া তখন নাকি বলেন, ‘কত বড় মুখড়া! গানটাই শুরু হচ্ছে না!’
পান পাতা দিয়ে মুখ ঢাকার আগেও সেই ঠাট্টা। শ্রেয়ার হাতে চারটে পান পাতা। মুখ ঢাকার আগে শ্রেয়া নাকি হেসে বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল চাই!’ রেকর্ডিংয়ের আগে যে ভাবে ওয়ান, টু, থ্রি… বলে গান শুরু হয়, ঠিক সে ভাবেই শান্তনু ‘কিউ’ দিলেন। তারপরই পিঁড়ি ধরার গুরুদায়িত্ব পড়ল শান্তনু, জিৎ আর জয়-এর উপর। ওঁদের সঙ্গে ছিলেন শ্রেয়ার কাকা আর ভাই। চার পাক ঘুরিয়ে শান্তনু ক্লান্ত। শেষ অবধি পিঁড়ি ধরে থেকে ঘাম ঝরিয়ে ফেললেন জিৎ আর জয়। তখন প্রায় মধ্যরাতের কাছাকাছি। পাশ থেকে এক আমন্ত্রিত বললেন, ‘‘এত দিন সুরকাররা শ্রেয়াকে দিয়ে খাটিয়ে খাটিয়ে গান রেকর্ড করেছে। বিয়ের পিঁড়িতে বসে শ্রেয়া সব খাটনি উসুল করে নিল।’’ মোবাইল ক্যামেরা ছিল। কিন্তু তিন জনেই সমস্বরে বললেন, ‘‘উৎসবের পরিবেশটাকে সম্মান জানিয়ে আমরা ছবি তুলিনি।’’
বিয়ের অনুষ্ঠানের পর পুরোদস্তুর বাঙালি মতে ভূরিভোজ। মাছ, মাংস, মিষ্টি। অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় ভোর। শুক্রবার সকালে শ্রেয়া গেলেন শিলাদিত্যর সান্তাক্রুজের ফ্ল্যাটে। মুম্বই থেকে ফিরে সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ কলকাতা এয়ারপোর্টে জয়ের সঙ্গে দেখা সুনিধি চৌহ্বানের। ‘‘ওকে বললাম যে, শ্রেয়ার বিয়ে থেকে ফিরছি। ও অবাক। বলল, সবে টুইটারে খবরটা জেনেছে,’’ হেসে বললেন জয়। হনিমুনে শ্রেয়া আর শিলাদিত্য যাচ্ছেন ইউরোপ। আগামী এক মাস কাজ রাখছেন না। ‘‘ওকে বলেছি এই সময়টা এনজয় করতে। ও সেটা ভালবেসেই মানছে,’’ বলছেন শান্তনু। কোনও রেকর্ডিং বা শো নয়। কিছু দিন মন দিয়ে শ্রেয়া ঘরকন্না করবেন যে!