তারেক রহমান ও ফখরুলের বক্তব্য রাজনৈতিক বার্তা না কৌশল?
ঢাকা জার্নাল ডেস্ক:
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তার পতনের পর ছাত্র-জনতার মতামতের ভিত্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়।
তখন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক দলগুলো এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এসব দলের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। এখন তারা শুধু রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে নজর দিচ্ছে না, বরং নির্বাচনের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে সামনে আনছে।
সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনের বিষয় নিয়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যে কিছু ভিন্নতা দেখা গেছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।” কিন্তু তার একদিন পর, গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ভিডিও কনফারেন্সে ঢাকা থেকে বক্তব্য দেওয়ার সময় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়া করতে চাননি। তিনি মির্জা ফখরুলের মতো ‘অবিলম্বে নির্বাচনের’ দাবি তোলেননি।
বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে ‘দোদুল্যমানতা’ হিসেবে দেখছেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুশতাক খান বলেন, এই দোদুল্যমানতার দুইটি কারণ রয়েছে। তার মতে, বিএনপি তাদের কর্মী ও সমর্থকদের নির্বাচনের চাহিদা এবং দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন— এই দুই বিষয় মাথায় রেখে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। কারণ, বিএনপির অনেক কর্মী-সমর্থক আছেন, যারা মনে করছেন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের দল ক্ষমতায় যেতে পারে।
কতদিন অপেক্ষা করবে বিএনপি?
নির্বাচনের আগে বিএনপি দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার করতে চায়। তারা মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ এবং বিচার বিভাগে সংস্কার আনাটা জরুরি।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য। তবে বিএনপি সংবিধান সংস্কার কমিশন নিয়ে খুব একটা খুশি নয়। তাদের মতে— সংবিধান সংস্কারের কাজ নির্বাচিত সরকারের হাতে থাকা উচিত। বিএনপি আশা করছে, ইউনূস ঘোষিত কমিশনগুলোর কাজ শেষ করতে আরও মাসখানেক লাগবে। এরপর পরবর্তী তিন মাসে কমিশনগুলো তাদের রিপোর্টগুলো চূড়ান্ত করবে এবং রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সেক্টরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এসব প্রক্রিয়া ছয় মাসের মধ্যে শেষ হওয়া উচিত। তাদের মতে, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের জন্য খুব বেশি দেরি হবে না। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এটা ঠিক আছে। তবে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, কেন এখনই নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করা যাচ্ছে না? আমরা নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বলছি না। সবাই বুঝতে পারছে যে কিছু সময় লাগবে। কিন্তু এই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারে, যাতে আমরা জানি কখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে ফিরবো। আমরা এটা চাই, তবে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নিয়ে কথা বলছি না।”
বিএনপি মনে করছে, প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় এখনও আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবিধাভোগীরা’ রয়েছেন। সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা বারবার বলছি, বিগত সরকারের কাঠামো যত দ্রুত সম্ভব বদলাতে হবে।”
তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বর্তমানে নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির আগ্রহ তেমন গুরুতর নয়। মুশতাক খান বলেন, বিএনপি হয়তো চাইবে যে কিছুটা হলেও দেশের দুর্বল অর্থনীতি ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি ঠিক হোক। তারপর তারা নির্বাচনের দাবি করবে। কিন্তু একই সঙ্গে তাদের নির্বাচনের কথাও বলতে হবে, নইলে দলটি শক্তিশালী রাখতে পারবে না।
শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে ভিন্নতা কেন?
শুরুর দিকে বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘সর্বোচ্চ সহযোগিতা’ দেবেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দিতে চান। তবে এই যৌক্তিক সময় কতদিন হতে পারে, তা স্পষ্ট করেনি দলটি।
মাহদী আমিন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই উপদেষ্টা বলেন, “তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিএনপি বারবার বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা। এই সময়ে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনপ্রশাসনে সংস্কারগুলো শেষ করতে হবে।”
গণতন্ত্র দিবসের জনসভায় তারেক রহমান বলেছেন, এই সরকারের ব্যর্থতা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হবে, তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।
অনেকে মনে করছেন, তারেক রহমানের এই বক্তব্য নির্বাচনের সময় নিয়ে নমনীয় মনোভাব প্রকাশ করছে। তবে মাহদী আমিন বলেছেন, তারেক রহমান এখানে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই তাদের ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।”
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিএনপি আপাতত মাঝামাঝি অবস্থান বজায় রাখতে চায়। তারা একদিকে সংস্কারের প্রতি সমর্থন দেখাতে চান, অন্যদিকে নির্বাচনের চাপও রাখতে চান।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সংস্কারের দাবি জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকেই এসেছে। যদি বিএনপি সরাসরি নির্বাচনের দাবি তুলে ধরে, তাহলে জনগণের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে। মুশতাক খান বলেন, বিএনপিকে দুটি দিক নিয়ে চলতে হবে। একদিকে বলবে নির্বাচন চাই, আরেকদিকে বলবে সমস্যার সমাধান চাই। এটাই তাদের জন্য স্বাভাবিক।
বিএনপি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত সম্ভাব্য নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টিতে নজর রাখছে। যদিও আন্দোলনের সমন্বয়করা বলছেন, তাদের নতুন দল গঠনের কোনো পরিকল্পনা নেই।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নতুন দল তৈরি করতে বলছেন। যদি নতুন দল গঠনের কথা ওঠে, তাহলে জনগণ কীভাবে বিশ্বাস করবে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন?”
তবে, মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সাথে তারেক রহমানের বক্তব্যের মধ্যে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। তারেক বলেন, “যদি কেউ মনে করে, একটি উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল প্রয়োজন, তবে এতে দোষের কিছু নেই। কারণ, শেষ পর্যন্ত জনগণই ঠিক করবে তারা কাকে সমর্থন করবে।”
তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন জানান, বিএনপি যেকোনো রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানায়, তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বা অনৈতিক সুবিধা ছাড়া তা হওয়া উচিত।
অন্যদিকে, নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী একে অপরের বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করছে। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, “এখন দেশের পরিস্থিতি খারাপ। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নিয়ে কথা বললে জাতি তা মেনে নেবে না।”
জামায়াতের এই বক্তব্য বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর জবাবে মির্জা ফখরুল আলমগীর বলেন, “যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এসব কথা বলে। আমি কোনো দলের নাম বলছি না, কিন্তু যারা নির্বাচনে জিততে পারবে না, তারাই নির্বাচনের বিরুদ্ধে কথা বলে।”
সূত্র: বিবিসি