টিনএজাররা আত্মহত্যা ঝুঁকিতে
ঢাকা জার্নাল: নিহার নিগার নোভা। বয়স ২০। মঙ্গলবার গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী নোভা। নোভার মতো নানা কারণে প্রতিবছর প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১২৮ দশমিক ৮ জন আত্মহত্যা করে । ২০১০ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চালানো এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সমাজবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সামাজিক বন্ধনে চিড় ধরা, অস্থিরতা ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-টানাপোড়েনে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।’ কিন্তু এর প্রতিকারে রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেই। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিংয়েরও কোনো ব্যবস্থা নেই।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত ৭ মাসে আত্মহত্যা করে এমন ১০৬ জনের লাশ ফরেনসিক বিভাগে আনা হয়েছে। গত জুলাই মাসে চট্টগ্রামে বিষপান ও ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে ১৬ জন। এদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ- তরুণী। এদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এসব ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ বলছে, পারিবারিক কলহের জেরে অধিকাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।
চমেক হাসপাতালে আত্মহত্যার চেষ্টাকারী রোগীর তথ্য :
২০০২ সালে ৬৭৭ জন, ২০০৩ সালে ৭৪৫, ২০০৪ সালে ৮০৩, ২০০৮ সালে ১৭৫১, ২০০৯ সালের ১১৩৪ জন। এর বেশি আর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য হাসপাতালে পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বাংলানিউজকে বলেন,‘আত্মহত্যার চেষ্টা করে জখম হওয়া বা এই কারণে অসুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। অনেকে মারাও যায়। যে সংখ্যক লোক আত্মহত্যা করে এর ১০ গুণ বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আত্মহত্যা করবে বলে চিন্তা করে তারও ১০ গুণ বেশি মানুষ। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পারিবারিক অশান্তি, কর্মক্ষেত্রের সমস্যায় বিপর্যস্ত হওয়ার কারণেই বেশি মানুষ আত্মহত্যা করছে।’
‘আত্মহত্যা বিশেষজ্ঞ’ বলে খ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেইম-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বাংলানিউজকে বলেন,‘যখন সামাজিক বন্ধনে ফাটল ধরে তখন সমাজে তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে।’
তিনি বলেন, ‘পারিবারিক বন্ধনে ফাটল ধরার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। টিনএজাররা আত্মহত্যা ঝুঁকিতে বেশি। এসমস্যা সমাধানে সামাজিক বন্ধন কিভাবে বাড়ানো যায় সে চিন্তা করতে হবে। মানুষ যত নগরমুখি হচ্ছে তত একান্নবর্তী পরিবার ভাঙ্গছে। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। পারিবারিক কলহও বাড়ছে। এর চাপ পড়ছে পরিবারের সন্তানদের উপর। যখন কেউ মনে করে তার বেঁচে থাকা অর্থহীন তখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।’
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশই আত্মহত্যা করে। শহর এলাকায় এ হার বেশি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৬৪ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) রয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরণের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের দেশের ছেলেরা যখন কোনো বিষয় নিয়ে হতাশায় ভোগে তখন সে কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ পরিস্থিতি থেকে তাকে বের করে আনতে আত্মহত্যা করার পেছনের কারণগুলো খুজেঁ বের করে সেগুলো দূর করার কার্যক্রম চালাতে হবে।’
প্রসঙ্গত, প্রতিবছর এক লাখ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করে ১২৮ দশমিক ৮ জন। ২০১০ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ বিভাগ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ প্রথমবারের মতো ‘বাংলাদেশের একটি গ্রামীণ জনপদে আত্মহত্যার ব্যাপ্তি নির্ণয় ও তথ্য উদ্ঘাটন’ শীর্ষক এই যৌথভাবে গবেষণাটি চালায়। আত্মহত্যার প্রবণতা ও বাস্তব চিত্র নিয়ে বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ের গবেষণা এটিই প্রথম।
ঢাকা জার্নাল, ২১ আগস্ট,২০১৩