চার দিনের হরতালে ক্ষতি ৪ হাজার কোটি টাকা
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলেছেন, সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রতি মাসেই রপ্তানি আদেশ কমছে। গত দু’মাসে শুধু পোশাক খাতেই কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ রপ্তানি আদেশ। এই পোশাক খাত থেকেই রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশ আসে, যার পরিমাণ সাড়ে ২১ বিলিয়ন ডলার। হরতালের কারণে একদিনে পোশাক খাতেরই ক্ষতি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যারা আদেশ দিচ্ছে তারাও আগের চেয়ে কম দিচ্ছে। এ অবস্থায় এ খাতের উদ্যোক্তারা হতাশ।
নভেম্বর মাসের প্রতি সপ্তাহে টানা হরতালে দেশের অর্থনীতি অন্যান্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি ও অন্যান্য নিত্যপণ্য সরবরাহ ভেঙে পড়ার কারণে একদিকে দিকে উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে ভোক্তার কাছে পণ্য না পৌঁছানোর কারণে পণ্যমৃল্য বৃদ্ধি হয়েছে। এ ফলে নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। টানা হরতালে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে শ্রমজীবী মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরতাল শুরুর আগের দিন শনিবারে যে ফুলকপি পাইকারি ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে, তা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। কাঁচা শাক-সবজি প্রতিদিন যে পরিমাণ নষ্ট হচ্ছে ও কম দামে বিক্রি করছে, এ ক্ষতিও কম নয়।
দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ-চাক্তায়ের ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, টানা হরতাল পড়লে বাজারটিতে প্রতি একদিনের ব্যবসায় মন্দা যায় ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ ওই বাজারে ৯০ ভাগ বেচাকেনা কমে যায়। আর নগদ টাকায় এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে ৮৪ ঘণ্টার হরতালে লোকসান হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের মাঝে বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনীতিবিদদের অনেকেই হিসাব করে বের করেছেন, প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ সৃষ্টি হয়ে। সহিংস হরতালে এই সম্পদ সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে। তবে কৃষি বা সেবা খাতের ক্ষতি রোধ করতে পারলে এ ক্ষতি কমবে। কিন্তু এখন যেভাবে হরতাল হচ্ছে তাতে অর্থনীতির সব খাত ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন যে ধরনের হরতাল হচ্ছে তা পুষিয়ে নেয়ার ক্ষমতা দেশের অর্থনীতির নেই। সহিংস এ হরতাল অর্থনীতিতে দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি প্রভাব পড়বে। ছোটখাটো বা একদিন-দুদিনের হরতাল হলে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।
বিজিএমইএয়ের সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ চৌধুরী বলেন, কৃষি ও সেবার ক্ষতি বাদ দিলেও এই সহিংস হরতালে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। সেই সঙ্গে ক্ষতি হচ্ছে দেশের ইমেজের। টানা চার দিনে হরতালে এ ক্ষতির পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। টানা হরতালের নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। তারা একদিকে যেমন অফিস-দোকান-কারখানার ভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল ও কর্মচারীর বেতন শোধ করছে। তাদের শোধ করতে হচ্ছে ব্যাংকের সুদ। কিন্তু উৎপাদন বা কেনাবেচা করতে পারছে না। এর ফলে পুঁজি হারাচ্ছে এসব ব্যবসায়ী।
হরতালের কারণে ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হরতালে সরবরাহ নেই, সরবরাহ না থাকার কারণে উৎপাদন নেই; আর উৎপাদন না থাকার কারণে অর্থের লেনদেন কমে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সার্কোলারের কারণে এমনিতেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী খেলাপির ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ হাজার কোটি টাকাতে পৌঁছেছে। গত তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায ৫ হাজার কোটি টাকা। হলমার্ক-বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ আত্মসাতের কারণে ব্যাংকিং খাত সতর্কতার সঙ্গে চলছিল, অর্থের সরবরাহ কমে গিয়েছিল, রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে বিনিয়োগও হচ্ছিল না। বিনিয়োগকারীরা ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করছে। ব্যাংকগুলোকে এখন খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে মুনাফা কমে গেছে। টানা হরতালে ব্যাংকের ওপর মড়ার উপর খাড়ার ঘা পড়েছে। লিখেছেন- জাফর আহমেদ, দৈনিক সংবাদ।
ঢাকা জার্নাল, নভেম্বর ১৩, ২০১৩।