চারু মজুমদারের চিঠি
চারু মজুমদার: বিপ্লবী হতে হলে নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করতে হয়। তবেই তো একটা মানুষের পরিবর্তন হয়। সে নতুন বিপ্লবী মানুষে পরিণত হয়।
তোমাদের এখন শেখার সময়। এখন নিশ্চয় শিখতে হবে। এখন শেখা বলতে শাসক শ্রেণী কী কী বোঝে আর আমরা কী বুঝি। শাসক শ্রেণী বোঝে যে শিক্ষা এমন হোক যাতে তাদের প্রয়োজন মেটে এবং সেই শিক্ষা মারফতে তারা তোমাদের উপযুক্ত করে তুলতে চায়, তাদের স্বার্থ সংরক্ষনের হাতিয়ার হিসাবে। তাই তারা শিক্ষাকে বাস্তব কাজ থেকে আলাদা করে রাখে এবং শিক্ষার ভেতর দিয়ে তারা তোমাদের জনতা বিরোধী আত্মচিন্তাকে প্রধান করে তোলে। তাই চেয়ারম্যান বলেছেন ‘The more you read,the more you become foolish’। কারণ যতো পড়বে ততো বাস্তব কাজ থেকে তুমি যাবে দূরে সরে এবং যতো পড়বে ততো তুমি হবে জনবিরোধী, আত্মম্ভির এবং আত্মকেন্দ্রিক; স্বার্থপরতা বেড়ে যাবে এবং বাস্তব কাজ থেকে বিচ্যুত থাকায় জনতার সেবার পক্ষে তুমি হবে ততো অনুপযুক্ত। তাহলে আমরা শিক্ষা বলতে কি বুঝি? আমরা জানি জ্ঞানের তিনটি সূত্র,
১) উৎপাদনের জন্য সংগ্রাম
২) শ্রেণী সংগ্রাম
৩) বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংগ্রাম।
জ্ঞানের তিনটি সূত্র সত্যি সত্যি তোমরা পাবে যদি তোমরা উৎপাদনের সাথে যুক্ত হও। আজকের সমাজে তোমাদের সে সুযোগ খুবই কম। তাই আজকের যুগে তোমাদের শিক্ষার ভিত্তি হওয়া উচিৎ-
১) মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাও-সে-তুঙের এর চিন্তাধারা আয়ত্ত করার শিক্ষা।
২) ভারতবর্ষের সংগ্রামের ইতিহাস
৩) আমাদের জীবনে দৈনন্দিন কাজের সমস্যা।
এইগুলোকে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যয়ন করতে হবে।এই শিক্ষাই খাঁটি শিক্ষা এবং এগুলো থেকেই তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ নির্ধারিত হবে। ডাক্তারি যদি শিখতেই হয় তাহলে শিখতে হবে এই ভারতবর্ষের মানুষকে রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত করার জন্য। এই ভারতবর্ষ হচ্ছে কৃষকের দেশ কাজেই কোটি কোটি কৃষকের জীবনে আধুনিক বিজ্ঞান এবং মনুষ্য সমাজের সমস্ত আরোগ্য পদ্ধতি নিয়ে যেতে হবে, যাতে তারা রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে পারে। এই সংগ্রামে তুমি হবে সৈনিক এবং তোমার লক্ষ হবে ব্যাপক কৃষক জনতাকে যাতে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারো-কয়েকটি বিশেষ রোগের বিশেষজ্ঞ হবার জন্য নিশ্চয় নয়। আমরা যা কিছু করবো, যা কিছু শিখবো সবই জনতার জন্য; তার মানে আমাদের দেশ কৃষকের জন্য। এই কৃষককে চেনা, কৃষককে বোঝা, কৃষকদের সাহায্য করার নামই হল দেশপ্রেম, যে দেশপ্রেমের জন্য জীবন দেওয়া প্রত্যেকটি মানুষের একটি পবিত্র কাজ। দৈহিক পরিশ্রম করতে যারা ভয় পায় তারা কিছু করতে পারেনা। আলস্য, নিষ্ক্রিয়তা হল সামন্তশ্রেণীর দান। শ্রমিক শ্রেণীর দর্শন শেখায় অক্লান্ত পরিশ্রম করতে। ভীরুতা, কাপুরুষতা ধনিক শ্রেণীর দান- কারণ তারা ব্যাক্তি স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়। তাই ধনিক শ্রেণীর সাহিত্যে কাপুরুষতার প্রশস্তি গাওয়া হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ যেহেতু সকলে মিলেই সিদ্ধ হতে পারে এবং সফল হতে পারে চরম ত্যাগস্বীকারে, তাই শ্রমিক শ্রেণীর দর্শন শেখায় মৃত্যুঞ্জয়ী সাহসের অধিকারী হতে।
ভবিষ্যতের মানুষ হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি কর।মনকে বিপ্লবী বানাতে হয় প্রথম।মানুষের অগ্রগতির ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। আর সংগ্রাম করতে হয় নিজের সাথে। বারবার ব্যাক্তি স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে। এই ব্যাক্তি স্বার্থ শোষণভিত্তিক সমাজের দান। স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানুষের চরিত্র পরিবর্তনের সংগ্রাম।সামাজিক মানুষ হওয়া সাধারন নয়। এই লড়াই শুরু হয়েছে মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবে।বিরাট জয়ের সম্ভাবনা আমাদের সামনে। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর।
[ “এবং জলার্ক” পত্রিকার অক্টোবর ২০০৯ – মার্চ ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত “চারু মজুমদারের অপ্রকাশিত চিঠি” এর নির্বাচিত অংশ। ]
ঢাকা জার্নাল, জুলাই ২৯, ২০১৫।