Leadমত-অমত

গরীবের ডাক্তার লিটু

কথার হাটের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকায় কোন কথাই কানে ঢুকেনি। এমন সময় “ আরে কন কি মান্নান কাকা?”- বলে লিটু চিৎকার দিয়ে লম্ফ দিয়ে পাশে বসা সাঈদ ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরল। ধরল তো ধরল, জুতো খুলে মোজা খুলে পায়ের ধূলো মাথায় ঘষতে ঘষতে বলল, “ গুরুর পায়ের অরিজিনাল ধূলো মাথায় না নিলে জীবন ধইন্য হবে না।”

আব্দুল্লাহ স্যারের মেডিসিন ক্লাসের প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। সবাই পিনপতন নীরবতায় তাঁর লেকচার শুনে যাচ্ছে। এমন সময় ক্লাসরুমের দরজা কটকট করে উঠল। সবার দৃষ্টি সেদিকে নিক্ষিপ্ত হল। দরজা গলিয়ে একটি মুখ ঘাঢ় মাথা গলাসহ ভেতরে উঁকি দিল। মুখের উপর লজ্জাহাসির কৌতুকময় এমন একটি ভঙ্গিমা যার সাথে রাগ করা তো দূরের কথা রাশভারি আব্দুল্লাহ স্যার তিরস্কার করার শক্তিও হারিয়ে ফেললেন।

তিনি শুধু বললেন,”এই যে আসেন আসেন! ব্রিলিয়ান্ট বয়। পরের ক্লাসের জন্য উনি আগেই আসলেন!”

সবাই মিটিমিটি নীরব হাসির একটা ব্রেক পেয়ে কিঞ্চিৎ আমোদ সঞ্চয় করে নীরস লেকচারে পুনরায় মন দিলাম।
ক্লাস শেষ হতেই, ‘আরে বস, আরে ওস্তাদ, আরে বড়দা , আর পারলাম না!’ এসব সম্মোধনে উচ্চস্বরে ক্লাসের প্রায় সবার সাথে একটা হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলল।

তার সাথে আগে দেখা হয়নি, পরিচয় হয়নি, নামও শুনিনি। কিন্তু মনে হল কতদিনের চেনা। তাই প্রথম পরিচয়ের বিস্ময় কাটতে না কাটতেই সে আমার কাছে এসে বলল, ‘বড়দা চলেন , চা চিনি খাই!’

মানুষকে কাছে টানার প্রচণ্ড শক্তি না থাকলে এভাবে কেউ বলতে পারে না। যাই হোক সবাই মিলে পিজি হাসপাতালের এ ব্লকের ক্যাফেটেরিয়ায় জমজমাট আড্ডা শুরু হয়ে গেল।

প্রথমে ভাবলাম কোন অজানা কারণে সে বোধ হয় আমার দিকেই ঝুঁকেছে। কিন্তু পথে যেতে যেতে যার সাথে দেখা সবার সাথেই সে একান্ত পরিচিতের ন্যায় হইহুল্লোড় মার্কা আলাপচারিতায় সাদামাটা একটা পরিবেশকে আন্তরিক ,আনন্দময় এবং কিছুটা রহস্যময়ও করে তুলছে।

পাঁচ তলার ক্যাফেটেরিয়ার জানালার পাশের টেবিলে বসে সবাই চা চিনি খাচ্ছি। নীচে শাহবাগের প্রশস্ত চত্বর চৈত্রের দুপুরে চিত হয়ে পড়ে আছে। তার বুকের উপর দিয়ে অগুনতি মানুষ যার যার গন্তব্যে চলমান। দুপুরের খাড়া রোদ যাত্রীদের ছায়াগুলো গিলে ফেলে সবাইকে নিঃসঙ্গ করে ফেলছে। বুকের ভেতর মরুর হাহাকার হুহু করে বয়ে চলে। এমন পরিপূর্ণ বন্ধুময় পরিবেশের ভেতর হঠাৎ নিজেকে কেন যেন বিক্ষিপ্ত , নিঃসঙ্গ এবং লক্ষ্যহীন পথিক মনে হল।

কথার হাটের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকায় কোন কথাই কানে ঢুকেনি। এমন সময় “ আরে কন কি মান্নান কাকা?”- বলে লিটু চিৎকার দিয়ে লম্ফ দিয়ে পাশে বসা সাঈদ ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরল। ধরল তো ধরল, জুতো খুলে মোজা খুলে পায়ের ধূলো মাথায় ঘষতে ঘষতে বলল, “ গুরুর পায়ের অরিজিনাল ধূলো মাথায় না নিলে জীবন ধইন্য হবে না।”

সাঈদ ভাই অপ্রস্তুত হয়ে “আরে কর কী কর কী লিঠু!” বলে পানের রসে টইটুম্বুর মুখখানায় একটা কপট রাগ এনে দাঁড়িয়ে পড়লেন কিন্তু পা সরালেন না।

সাঈদ ভাই দীর্ঘদিন ধরে মেডিসিন দ্বিতীয় পর্বে আটকে আছেন। পাশ করার কোন আশু সম্ভাবনাও নেই। একজন শিক্ষিত ডাক্তারকে মুখ লাল করে এমনভাবে পান খেতে আগে কখনো দেখিনি। পানের প্রচন্ডতায়, নাকি সিলেটি অ্যাকসেন্টের কারণে সাঈদ ভাই লিটুকে ‘লিঠু’ বললেন তা তখনো পরিষ্কার জানতাম না।

হাতিরপুলের জজ গলির সাত নম্বর বাড়ির নীচ তলায় বিচার বসেছে। বাদী: লালমুখো সাঈদ ভাই। বিবাদী: হবিগঞ্জের সদ্য বিলাতী লাইলী বেগম। জুরি বোর্ডের তিনজন সদস্য: দীপল মহাজন, রনি জমাদ্দার এবং লিটু।

বাদীর অভিযোগনামা: লাইলী বেগম একটানা সাত বছর প্রেম করে সাঈদ ভাইয়ের পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার অজুহাত তুলে কোন কারণ দর্শাও নোটিশ জারী না করেই লন্ডনী এক ভাতের দোকানদারকে বিয়ে করে রাতের অন্ধকারে সিলেট থেকে বিমানে চড়ে বিলাত পাড়ি দিয়েছে। এতে সাঈদ ভাইয়ের অগুনতি আর্থিক এবং প্রভূত মানসিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এই অন্যায়ের ন্যায় বিচার পাবার জন্য বাধিত আবেদন পেশ করা হল।

টানা সাতদিন ধরে শুনানী চলল। বিবাদী অনুপস্থিত। বাদীপক্ষ তার সপক্ষে পর্যাপ্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করল। মান্যবর আদালত বিবাদীর অযৌক্তিক অনুপস্থিতিতে তাকে অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করলেন। এবং রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারকগণ এই নীতিবাক্য সংযোজন করলেন যে, বাদী নিজেও একজন লন্ডনী পাত্রীকে বিবাহপূর্বক বিলাতগামী বিমানে আরোহন করুক।

জজ গলির এই জাজমেন্ট ঘোষিত হবার দু’সপ্তাহের মাথায় সাঈদ ভাই রায় বাস্তবায়ন করে তবে ঢাকায় ফিরলেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের পঞ্চম তলার ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে সাঈদ ভাই এই বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করা মাত্র লিটু “ আরে কন কী মান্নান কাকা?” বলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

এই হল “কন কী মান্নান কাকা”র রহস্যকথা।

(প্রথম পর্ব)