কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উত্তরা ইপিজেড
মো.মামুন অর রশিদ
সূর্য উঠার আগে নীলফামারী-সৈয়দপুর সড়কে মানুষের দলবেঁধে ছুটে চলা। কেউ যাচ্ছেন সাইকেলে,কেউ ইজি বাইকে,কেউ মোটর সাইকেলে,কেউ বা আবার পায়ে হেঁটে। প্রথম দেখায় কারও মনে হতে পারে তারা কোনো মিছিলে বা ধর্মঘটে যাচ্ছেন। তাদের গন্তব্য কোনো মিছিল বা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ নয়,তাদের গন্তব্য উত্তরা ইপিজেড। কর্মের উদ্দেশে শ্রমজীবী মানুষের এই ছুটে চলা দেখলেই মনে হয় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। একসময়ের মঙ্গা-কবলিত রংপুর অঞ্চলে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া, বেড়েছে কর্মসংস্থান। রংপুর অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উত্তরা ইপিজেডের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা।
নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নে ২১৩ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তরা ইপিজেড। ২০০১ সালের ১ জুলাই এই ইপিজেডের কার্যক্রম শুরু হয়। উত্তরা ইপিজেড চালুর পর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। সরকারের বিনিয়োগবান্ধব নীতির কারণে উত্তরা ইপিজেডে বিনিয়োগে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। এছাড়া যোগাযোগের ক্ষেত্রেও উত্তরা ইপিজেড সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। নীলফামারী-সৈয়দপুর সড়কের পাশে এই ইপিজেডের অবস্থান। এই ইপিজেড থেকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের দূরত্ব মাত্র ১৬ কিলোমিটার। বর্তমান এই ইপিজেডে রয়েছে ৩৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ২৫টি উৎপাদনরত এবং ৮টি বাস্তবায়নাধীন। উত্তরা ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। ইপিজেডের অধিকাংশ শ্রমিক নীলফামারী জেলার। রংপুর বিভাগের অন্যান্য জেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার শ্রমিক এই ইপিজেডে কাজ করছেন। এই ইপিজেডে অল্পকিছু সংখ্যক বিদেশি শ্রমিকও রয়েছেন।
কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী,উত্তরা ইপিজেডের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মাসিক বেতন ১২ হাজার ৮০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ বেতন ১৭ হাজার টাকা। অধিকাল ভাতা ও অন্যান্য প্রণোদনা হিসাব করলে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মাসিক বেতন দাঁড়ায় ১৫ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ বেতন দাঁড়ায় ২৭ হাজার টাকা। ইপিজেডে কর্মরত ৩৫ হাজার শ্রমিকের গড় বেতন ন্যূনতম ১৮ হাজার টাকা ধরলেও তাঁদের মাসিক আয় দাঁড়ায় ৬৩ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে ৩৫ হাজার পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। এই শ্রমিকদের একটি বড় অংশ একসময় তিন বেলা ভালোভাবে খেতে পারতেন না। ইপিজেডে কর্মসংস্থান হওয়ায় তাঁরা এখন ভালোভাবে চলতে পারছেন,সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যয় মেটাচ্ছেন। সহজভাবে বললে এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের জীবনমানের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে।
রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রেও বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে উত্তরা ইপিজেড। গত পাঁচ বছরে উত্তরা ইপিজেড থেকে মোট ১২৫ কোটি ৬৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। ইপিজেডে বাস্তবায়নাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গুলো যখন চালু হবে,তখন একদিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থান হবে অন্যদিকে রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
রপ্তানি আয়েও পিছিয়ে নেই উত্তরা ইপিজেড। এ পর্যন্ত এই ইপিজেড থেকে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ২ হাজার ৪৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। ইপিজেডে বিনিয়োগে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে এই রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে।
উত্তরা ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে। এই ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্যের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বর্তমান উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে পরচুলা,চশমা,লেদার ব্যাগ,খেলনা,পোশাক,কফিন,প্রিন্টার, ফেস্টিভ্যাল কার্নিভেল আইটেম ও গামেন্টস যন্ত্রাংশ। উৎপাদিত এসব পণ্য দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
উত্তরা ইপিজেডকে কেন্দ্র করে নীলফামারী জেলার আর্থসামাজিক উন্নয়নকে একটু আলাদা করেই বলতে হয়। গত কয়েক বছরে নীলফামারী জেলায় দারিদ্র্য অনেক কমেছে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে। ইপিজেডের আশপাশ এলাকায় শ্রমিকদের থাকার জন্য গড়ে উঠেছে নতুন আবাসন ব্যবস্থা। স্থানীয় ব্যাবসা-বাণিজ্যেও গতি এসেছে। সর্বোপরি এই ইপিজেডকে কেন্দ্র করে নীলফামারী একটি শিল্পনগরীতে পরিণত হয়েছে। শুধু নীলফামারী নয়,বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও উত্তরা ইপিজেডের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। উত্তরাঞ্চলের বেকারত্ব দূরীকরণ ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এই ইপিজেড একটি নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক:সিনিয়র তথ্য অফিসার,রংপুর