করোনা ভাইরাস কী বার্তা দিচ্ছে?
ট্রাম্প যখন করোনার ‘গ্রীষ্মকালীন তত্ত্ব’ উপহার দিচ্ছিলেন ঠিক তার দুদিন আগে একটি রুশ সাংবাদমাধ্যম ‘চীন থেকে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মরণভাইরাস করোনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জড়িত’ বলে প্রচার করে। করোনা অর্থ মুকুট আর ট্রাম্প সুন্দরী প্রতিযোগিতায় মুকুট পরিয়ে দিতেন- এই সূত্র মিলিয়ে ট্রাম্পকে ‘করোনার জন্য’ দায়ী করে বসে পত্রিকাটি।
মুশকিলটা হচ্ছে তখনই যখন আপনি সবই জানেন, বোঝেন, দেখেন- কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সিদ্ধান্তের জন্য অসহায়ভাবে আপনাকে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাও আবার তার দিকে- যিনি দেখেও দেখছেন না, শুনেও শুনছেন না। শুধু মাঝে মাঝে আপনাকে নিয়ে মশকরাই করে যাচ্ছেন।
বিশ্বের অনেক দেশের মন্ত্রী আর আইনপ্রণেতাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি দায়িত্ববোধ আর অগ্রসর জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকেন সেখানকার বিশেষজ্ঞ কিংবা বিজ্ঞানীরা। অনেক ক্ষেত্রে গবেষণায় নিযুক্ত শিক্ষার্থীরাও যে কোনো সমস্যার গোড়ার খবর রাখতে পারেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা গিয়ে পড়ে অনেক ক্ষেত্রে মূর্খ, কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্ত্রী কিংবা আইনপ্রণেতাদের হাতে। যাদের অগ্রসর জ্ঞান তো দূরের কথা বাস্তবজ্ঞানই থাকে না অনেক ক্ষেত্রে।
আমার এই বক্তব্যের শানে নুযুলটা হচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট ‘উন্মাদ’ প্রেসিডেন্ট বললে খুব কমই বলা হবে মনে হয়। মার্কিন নাগরিকদের জন্য সত্যিই করুণা হয় আমার- এজন্য যে এমন একজনকে তারা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যিনি কিনা গোটা বিশ্বের মোড়লের পদ অলংকৃত (কলঙ্কিত!) করেছেন।
গেল বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস নিয়ে তার বক্তব্য আবারো প্রমাণ করলো ট্রাম্প মানবসভ্যতার জন্য কতটা বিপজ্জনক। গেল ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে করোনাভাইরাস নিয়ে ট্রাম্প তার ‘গ্রীষ্মকালীন তত্ত্ব’ প্রকাশ করেছেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী ‘তাপমাত্রা বাড়লেই ভাইরাস দূর হবে’। তিনি এও আশা করেছেন, ‘এপ্রিলে গরম শুরু হলেই করোনাভাইরাস পালিয়ে যাবে’।
জলবায়ু পরিবর্তনকে পরিবেশবিজ্ঞানীদের ষড়যন্ত্র হিসেবে বিশ্বাস করা বিশ্ব মোড়ল ট্রাম্প আবার তার করোনাতত্ত্বের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এসে। মার্কিন মুল্লুকে করোনা ঢুকে পড়ার জন্য ডেমোক্র্যাটদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছেন, ‘আমার ব্যর্থতা নয়, বরং ডেমোক্র্যাট সরকারের অভিবাসন নীতির কারণেই করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারে’। শুধু কি তাই তিনি করোনাভাইরাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান সমালোচনা ‘বিরোধীদের নতুন ধাপ্পাবাজি’ হিসেবেও সমালোচনা করেছেন।
এমন একজন রাষ্ট্রপ্রধানের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস ম্যানেজমেন্টটা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। রোম যখন পোড়ে তখন সম্রাট নিরো সত্যিই বাঁশি বাজিয়েছিলেন কিনা সে বিতর্কে না গিয়ে বিশ্বের আরেক ‘মোড়ল দেশ’ রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমের খবর পড়ে আরেকবার ধাক্কা খেতে হয়।
ট্রাম্প যখন করোনার ‘গ্রীষ্মকালীন তত্ত্ব’ উপহার দিচ্ছিলেন ঠিক তার দুদিন আগে একটি রুশ সাংবাদমাধ্যম ‘চীন থেকে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মরণভাইরাস করোনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জড়িত’ বলে প্রচার করে। করোনা অর্থ মুকুট আর ট্রাম্প সুন্দরী প্রতিযোগিতায় মুকুট পরিয়ে দিতেন- এই সূত্র মিলিয়ে ট্রাম্পকে ‘করোনার জন্য’ দায়ী করে বসে পত্রিকাটি।
ট্রাম্প যদি করোনা নিয়ে এমন তত্ত্ব দিতে পারেন, তাহলে ভ্লাদিমিরি পুতিনের দেশের পত্রিকায় লেখা গল্প অযৌক্তিক হয় কি? তবে উত্তর কোরিয়ায় প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে সে খবরটা কিন্তু অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য। কারণ উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিস্ময়কর সখ্যতাই আমাদের তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।
এর আগেও বলেছি, রাষ্ট্রনায়কদের বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক সীমাবদ্ধ জ্ঞান, অজ্ঞতা, মূর্খতা থেকে নেয়া বহুমুখী সিদ্ধান্ত আর তার প্রয়োগ পৃথিবীর টিকে থাকার জন্য দিন দিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তার ওপর আবার বিজ্ঞানমূর্খ, ধর্মান্ধ, প্রবলমাত্রার জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনায়কদের সংখ্যা বিশ্বে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। যাদের কাছে পৃথিবী কোনোভাবেই নিরাপদ নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা করোনাভাইরাস নয়, বরং ট্রাম্প, পুতিন, কিম জং উন কিংবা আমাজন পোড়ানো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর মতো রাষ্ট্রপ্রধানরাই বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। বর্তমানে আমরা নতুন এক মহাবিপদের সামনে দাঁড়িয়ে। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ইতোমধ্যে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস।
ইতোমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে করোনা ভাইরাসে লন্ডনে ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কাকে সামনে রেখে গণকবরের প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্রিটেন। অনেকেরই আশঙ্কা, ভয়াবহ করোনার থাবায় বিশ্বে ছয় থেকে সাত কোটি মানুষ প্রাণ হারাতে পারেন।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, দিন দিন উষ্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবী পৃষ্ঠ। বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। এতে ঘুমিয়ে যাওয়া জীবাণু জেগে উঠছে। এক ঋতুর রোগ প্রলম্বিত হচ্ছে অন্য ঋতুতে। আবার ঋতুভিত্তিক রোগব্যাধি ঋতুর সীমা অতিক্রম করে সারা বছরই থাকছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, খাদ্য ও সম্পদের অপচয়, জীবনধারার পরিবর্তনে অসংক্রামক ব্যধির বিস্তার ঘটছে হু হু করে।
করোনাভাইরাসের মতো রোগব্যধির বিস্তার মহাবিপদ হয়ে সভ্যতার দিকে ধেয়ে আসছে। আগামীতেও এভাবে আসতেই থাকবে। আমরাও প্রাণপণ চেষ্টায় অগ্রসর জ্ঞান আর প্রযুক্তি দিয়ে এসব মহাবিপদ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। তবে সমস্যাটা হচ্ছে, যারা সিদ্ধান্ত নেবেন, পরিচালিত করবেন সমস্ত কার্যক্রম- তারাই যদি হন কাণ্ডজ্ঞানহীন মূর্খ, হঠকারী- তাহলে আমাদের সামনে অনিশ্চিত গন্তব্য ছাড়া আর কি-ই বা থাকে? করোনা কি আমাদের সেই অসহায় অনিশ্চিত গন্তব্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে?
- নিয়ন মতিয়ুল, লেখক, সাংবাদিক