এক লাখ কোটি অলস টাকা নিয়ে বসে আছে ব্যাংক
দেশের ব্যাংক খাতে এখন অতিরিক্ত তারল্য আছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। কয়েক বছর ধরে অলস টাকার এই পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
আক্ষরিক অর্থেই টাকা নিয়ে বসে আছে ব্যাংক। কিন্তু ঋণ নিচ্ছেন না শিল্পোদ্যোক্তারা। বাড়ছে না বেসরকারি খাতের ঋণ নেওয়ার হার। দেশে নতুন বিনিয়োগ তেমন হচ্ছে না। এর ফলে ব্যাংকে বাড়ছে অলস টাকার পরিমাণ। দেশে না করলেও উদ্যোক্তারা এখন বিনিয়োগের জন্য দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছেন।
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, অর্থনীতির গতি বাড়লে ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত তারল্য থাকে না। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, দেশের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে তা হয়তো বলা যাবে না, তবে একধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গতি কমেছে অর্থনীতির।
তারই প্রমাণ হচ্ছে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অলস অর্থ।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে মূলধনের অভাব নয়, বরং বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর উদ্যোক্তারা বলছেন, তাঁরা বিনিয়োগ করতে চান। অর্থও আছে। কিন্তু দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের ঘাটতি আছে। অবকাঠামোর সমস্যা তো ছিলই। নতুন করে গ্যাস পাওয়া নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিনিয়োগ না বাড়ার এখন সবচেয়ে বড় কারণ গ্যাস-সংকট। নতুন করে গ্যাসের সংযোগ আর সরকার দিচ্ছে না। আবার দাম বেশি দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ।
অলস টাকার পাহাড়: নিয়মানুযায়ী দেশের ব্যাংকগুলোকে নগদ ও বিধিবদ্ধ (সিআরআর ও এসএলআর) বিভিন্ন উপকরণে অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়। সব মিলিয়ে এ জন্য রাখতে হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য রাখতে হয় আরও কিছু নগদ অর্থ। অথচ এখন আছে প্রায় ২ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ নগদ অর্থ বেশি আছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগ স্থবিরতায় অলস টাকা তিন গুণ বেড়েছে বলেই ব্যাংকাররা জানান।
ব্যাংকে টাকা অলস থাকার বিষয়টি মূলত সরবরাহ-জোগানের ওপর নির্ভর করে। এখন অর্থের সরবরাহ ঠিক আছে। কিন্তু চাহিদা নেই। এমনিতেই বিনিয়োগ কম। তার ওপর দেশের উদ্যোক্তারা এখন বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ নিতে পারছে। ফলে ঋণের চাহিদা আরও কমে গেছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান, বেসরকারি মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘একসময় আমরা ব্যাংকাররা বলতাম তারল্যের সংকটের কথা। এখন অতিরিক্ত তারল্যই বরং সংকটে পরিণত হয়েছে।’
এ পরিস্থিতিতে অর্থ অলস পড়ে থাকায় ব্যাংকের লাভ কমে যাচ্ছে বলে জানালেন মোহাম্মদ নুরুল আমিন। তিনি বলেন, লাভ কমলে লভ্যাংশও কম হবে। লাভ কমলে খরচ কমানোর কথাও ভাবতে হয়। পাশাপাশি সরকারেরও রাজস্ব আয় কমছে। ব্যাংকগুলো কিন্তু বৃহৎ করদাতা ইউনিটের অন্তর্ভুক্ত। করপোরেট কর দিতে হয় ৪০ শতাংশ। ১০০ কোটি টাকা মুনাফা কমা মানেই সরকার পেল না ৪০ কোটি টাকা। মূলত গত বছর থেকেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
বিনিয়োগের বিদেশ যাত্রা: দেশের মধ্যে বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকায় দেশের উদ্যোক্তারা এখন বিনিয়োগ করতে চান বিদেশে। দেশের বাইরে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ দেশের উদ্যোক্তাদের হাতে আছে বলেও জানালেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে কয়েকজন উদ্যোক্তা বিদেশে বিনিয়োগ করার অনুমোদন চেয়েছেন। এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতের দুলাল ব্রাদার্স (ডিবিএল) ইথিওপিয়ায় কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল করার অনুমোদন পেয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা এখন ইথিওপিয়া ছাড়াও হাইতিতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এরই মধ্যে হংকংয়ে বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে দাওয়াত করে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে ইথিওপিয়াও বিনিয়োগে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলোর কথা বলেছে।
এ কে আজাদ জানান, হাইতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে স্বল্পতম সময়ে পণ্য পাঠানো যায়। সেখানে আছে জলবিদ্যুৎ, যার দাম অনেক কম। আর যে জমিতে শিল্প স্থাপন করা হবে, সেখানকার ভাড়া দিতে হবে না পাঁচ বছর। ইথিওপিয়ার সুযোগ-সুবিধা আরও ভালো। এসব কারণে দেশের উদ্যোক্তারা ওই সব দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ না করে উদ্যোক্তারা কেন অন্য দেশে যেতে চাচ্ছেন, জানতে চাইলে এ কে আজাদ বলেন, ক্রেতারা চায় সব ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যেও আমরা যেন পণ্য সরবরাহ করতে পারি। সুতরাং হাইতি বা অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করলে সরবরাহের দ্বিতীয় একটি উৎস সব সময় খোলা থাকবে। তিনিও মনে করেন, গ্যাস-সংকটই এখন দেশে বিনিয়োগ না হওয়ার বড় কারণ।
প্রবৃদ্ধির ফাঁদ: মূলত, বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে সফল হয়নি। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর এখন সেই বিনিয়োগ মাত্র দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২২ দশমিক ০৭ শতাংশ। বেসরকারি বিনিয়োগ মূলত বছরের পর বছর একই জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না বলেই জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও ৬ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। স্বাধীনতার পর প্রতি দশকে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১ শতাংশ হারে। কিন্তু বিনিয়োগ স্থবিরতায় ১২ বছর ধরে দেশের গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ঘরেই। এটিকে এখন বলা হচ্ছে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ফাঁদ। কেবল বিনিয়োগের অভাবে এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না দেশ।
বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতার জন্য সরকার কয়েক বছর ধরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়িয়েছে। এর ফলে ২০০৮-০৯ সময়ে জিডিপিতে সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ, আর এখন সেটি হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। যদিও সরকারি বিনিয়োগের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক।
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এখন বিনিয়োগের হার প্রায় ২৯ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশের যে মাথাপিছু আয়, সে অনুযায়ী এ দেশে বিনিয়োগের হার হওয়া উচিত ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ থাকলেও তা বিনিয়োগে আসছে না।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের তথ্য বিশ্লেষণ করলে বিনিয়োগ স্থবিরতার চিত্র পাওয়া যায়। ২০১০-১১ অর্থবছরেও বেসরকারি খাতে ঋণ নেওয়ার প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ শতাংশেরও বেশি। সেটি এখন ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য ছিল সাড়ে ১৫ শতাংশ।
রিজার্ভের যন্ত্রণা: বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও জমছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৬৩৪ কোটি ডলার। সাধারণত তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রাখার রীতি রয়েছে। কিন্তু দেশে এখন প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান অর্থ মজুত আছে। এই অর্থ ব্যয়েরও পথ পাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ৮৫ শতাংশই এখন বাংলাদেশের বাইরে রাখা আছে এবং এ জন্য বাংলাদেশের আয় হচ্ছে মাত্র ১ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে যে ৪৮৯ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে, তার গড় সুদ হচ্ছে ৪ শতাংশ। ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকেও তেমন আয় হচ্ছে না।