আমি মেঝেতে ঘুমাবো, আর কোথাও যাবো না

জানুয়ারি ১০, ২০২০

ঢাকা অবতরণের ১০ মিনিট আগে বিমানবালা মিলার এসে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘ইচ্ছে করলে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব ঢাকা দেখতে পারেন।’ কিন্তু অনেক স্মৃতির ভীড়ে তিনি সেই কথায় সাড়া দেননি। এরপর দিল্লি থেকে তাঁর সফরসঙ্গী বাসসের সাংবাদিক আতাউস সামাদ বঙ্গবন্ধুকে বলেন,  ‘আপনি ঢাকা দেখতে পারেন।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিমান থেকে প্রিয় শহর ঢাকাকে দেখতে থাকেন। সাংবাদিক আতাউস সামাদ পরে তার প্রতিবেদনে লেখেন— তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি ঢাকায়। আমি আমার জনগণের মধ্যে ফিরে এসেছি।’

বসে পড়ে আবারও তিনি বলতে থাকেন, ‘আজ  রাতে আমি আমার বাড়িতে বাস করবো। আমি মেঝেতে ঘুমাবো,কিন্তু আর কোথাও যাবো না।’ বলতে বলতে তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

বাসস পরিবেশিত এই সংবাদটি আতাউস সামাদের বরাত দিয়ে ১১ জানুয়ারি প্রকাশ করে দৈনিক বাংলা।

প্রতিবেদক লিখেছেন, সাংবাদিকরা বহু রাজনীতিককে দেখে থাকেন। কিন্তু সাংবাদিকরা রাজনীতিকদের সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখার সুযোগ কমই পেয়ে থাকেন। দিল্লি থেকে ঢাকা তিনিই (আতাউস সামাদ) একমাত্র সাংবাদিক সফরসঙ্গী ছিলেন। বিমানে উঠেই বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেসা করেন, ‘তুমি কি এখনও বেঁচে আছো?’

দিল্লি থেকে ঢাকা ১৪২ মিনিট সময় বঙ্গবন্ধু সহকর্মী ও বন্ধুদের খোঁজ করেন। আতাউস সামাদ লিখছেন, ‘যশোরের মশিউর রহমানকে হত্যার কথা শুনে ভেঙে পড়েন। তিনি আমার পেশায় নিয়োজিত সুপরিচিত নামগুলো সম্পর্কে আবারও প্রশ্ন করেন। আমি জনাব শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দীন হোসেন, ডা. আবুল খয়ের, নাজমুল হক, নিজাম উদ্দীন, ডা. ফজলে রাব্বী, আহাদ, সায়দুল হাসান, মামুন মাহমুদ, ডা. আলীম চৌধুরী— সবাই চিরদিনের জন্য চলে গেছেন, অথবা তারা চলে গেছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে বলে জানালাম। প্রত্যেকের নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ বিষণ্ন ও বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।’

এর কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু আপন  মনে ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলো’ কবিতাটা নিজে নিজে আওড়াতে থাকেন। ইয়াহিয়ার সামরিক ট্রাইব্যুনালকে তিনি কী বলেছিলেন সে কথাও হচ্ছিল— ‘আমি তাদের বলেছি যে, আমি তোমাদের কাছে বিচার চাই না। কারণ,  তোমরা একা নও। আমি সর্বশক্তিমানের আশির্বাদ চাই। আমি আল্লাহ বিশ্বাস করি। আমার কোনও ভয় নেই। আমি মরণে প্রস্তুত রয়েছি। কিন্তু আমি জানি যে, আমার বাংলাদেশ মুক্ত হবে।’ কিন্তু আনন্দঘন এই মুহূর্তও ক্ষণস্থায়ী হয়। তিনি আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন— ‘তারা আমার বাড়িটি কী করেছে? তারা কি সেটি পুড়িয়ে দিয়েছে?’ আমি বললাম, ‘না, আপনার ধানমন্ডির বাড়ি বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলেও বাড়িটি অটুট রয়েছে। বাস করার জন্য সামান্য মেরামত করতে হবে।’ জানতে চাইলেন, ‘তারা আমার গ্রামের বাড়ির কী করেছে? সেটিও কি তারা পুড়িয়ে দিয়েছে?’ আমি বললাম, হ্যা। এতে তিনি শান্ত হয়ে পড়েন।

এরপর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ জুড়েন। তিনি মুক্তিবাহিনীতে তার ছেলের ভূমিকা কী ছিল জানতে চান। ছেলের তৎপরতার কথা শুনে তিনি আনন্দিত হন। এবার তিনি তার নির্দেশ— ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পুনরাবৃত্তি করেন।

বিশেষ বিমানের পাইলট মি. কুকসহ বিমানের সব ক্রুকে কৃতজ্ঞতা জানান বঙ্গবন্ধু, তার সফর আনন্দদায়ক করার জন্য। মি. কুক সাংবাদিকদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি অনেক বিশ্ব বরেণ্য নেতাকে আমার প্লেনে যাত্রী হিসেবে পেয়েছি, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে যাত্রী হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিত।’ ঢাকায় নামার আগে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান ঢাকার আকাশে কয়েকবার চক্কর দেয়। তার কারণ হিসেবে কুক আতাউস সামাদকে জানান, ‘বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা দেখানো এবং তেল কিছুটা কমিয়ে আনার জন্য অবতরণের আগে কয়েকদফা বিমান আকাশে চক্কর দেওয়া হয়।’ পরে ১১ জানুয়ারি বিমানটি ফিরে যায়।