‘অপরিহার্য’হয়ে ওঠা অনুশীলন বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য দিনে দিনে অপরিহার্য হয়ে ওঠা অনুশীলনমূলক বই বন্ধের প্রস্তাবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগের ছায়া নেমে এসেছে। বর্তমানে ৯৫ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী অনুশীলনমূলক বই পড়ে। তাই এসব বই বন্ধ করে দেওয়া হলে তা ফলাফল বিপর্যয়সহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষক, ও অভিভাবক মহল। পাশাপাশি প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের আশঙ্কা, বিষয়টি তাদের জন্যও বিপর্যয় ডেকে আনবে।

মূলত শ্রেণিকক্ষে যথাযথভাবে পাঠদান না হওয়া, সিলেবাস শেষ করার মতো সময় না পাওয়া ও সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে না পারার কারণে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই অনুশীলন বইয়ের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। বইগুলো শিক্ষার্থীদের নিজে থেকে পাঠগ্রহণ ও অনুশীলনে সহায়তা করার কারণে সার্বিকভাবে এর এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৯-এ নোট-গাইড বন্ধের বিধি যুক্ত করা হয়েছে। এর খসড়া গত সপ্তাহে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উঠবে বলে জানা গেছে। প্রস্তাবিত আইনে শিক্ষকদের সবধরনের কোচিং-টিউশন নিষিদ্ধ, শর্তসাপেক্ষে ব্যবসায়িক কোচিংকে বৈধতাদান করা হয়েছে।

সরকার নোট-গাইডের বিকল্প খুঁজছে বলে জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘নোট গাইড কেন চলে তা আমরা জানতে চাই। সেটা চিহ্নিত করার পরে আমরা পরবর্তী অ্যাকশনে যেতে পারি। আমরা চাই, নোট-গাইডের ওপর শিক্ষার্থীদের নির্ভরশীলতা কমাতে। তবে কী করব সেটা এখনও চূড়ান্ত নয়। আমাদের হাতে কয়েকটা বিকল্প আছে।’

অনুশীলন বই নিয়ে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তায় উদ্বিগ্ন অনেক অভিভাবক। তাঁরা বলছেন, সন্তানের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োজনেই তাঁরা এসব বই কিনছেন। রাজধানীর একটি সরকারি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো লেখাপড়া হলে নোট-গাইডের দরকার হতো না। আমার ছেলের ক্লাসে অনেক সময় রোল কল করতে এবং আগের পড়া নিতে নিতেই শিক্ষকের সময় শেষ হয়ে যায়। ফলে তিনি আর নতুন কিছু পড়ানোর সময় পান না।’

সৃজনশীল পদ্ধতির কারণেও অনুশীলনমূলক বই শিক্ষার্থীদের বড় অবলম্বন হয়ে উঠেছে। এ পদ্ধতিতে পাঠ অনুশীলনের জন্য অনেক উদ্দীপকের দরকার হয়, যার জন্য সহায়ক বইয়ের সাহায্য নেওয়ার বিকল্প নেই। কেননা, এত উদ্দীপক তৈরি করার সময় সাধারণত শিক্ষকদের থাকে না। সব শিক্ষকের সে যোগ্যতাও নেই। ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালুর এক যুগ পরেও দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকই এখনো সঠিকভাবে এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারেন না।

নাম প্রকাশ না করে রাজধানীর একটি স্কুলের অধ্যক্ষ বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপারে সব শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাননি। শিক্ষক ম্যানুয়াল দেখে পাঠদানের সক্ষমতা তাদের সবার নেই। এ কারণে অনেক শিক্ষকই গাইড বইয়ের সহায়তা নেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফৌজিয়াও প্রায় অনুরূপ মত দেন।

শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বর্তমানে দেশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে দুই ধরনের সমস্যা বিরাজমান। শহরের অনেক নামী প্রতিষ্ঠানে এক একটি ক্লাসরুমে ৮০ থেকে ১০০ জন শিক্ষার্থী থাকে। ফলে শিক্ষকেরা পাঠদানে শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দিতে পারেন না। আবার গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের দক্ষতা ও যোগ্যতার ঘাটতি আছে। অনেক স্থানে শিক্ষকের সংখ্যাও কম বা কখনো কখনো দীর্ঘসময় পদ শূন্য থাকে। সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশিক্ষণ বেশিরভাগ শিক্ষকই পাননি। আবার যাঁরা পেয়েছেন তাঁদের কার্যত দেওয়া হয়েছে নামেমাত্র প্রশিক্ষণ। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে অনুশীলনমূলক গ্রন্থ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এই খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘নোট-গাইড’ নিয়ে সরকারের আপত্তির একটি বড় কারণ হচ্ছে, একশ্রেণির অসাধু শিক্ষক ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থ কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন। শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ একে সৃজনশীলতা চর্চার পরিপন্থী বলেও মনে করেন।

প্রকাশকরা বলছেন, বস্তুত শিক্ষার্থীদের অনুশীলনের জন্য শিখনফলভিত্তিক নমুনা প্রশ্ন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার প্রশ্ন ও তার নমুনা উত্তর, উত্তরের ব্যাখ্যা এবং নিজে নিজে উত্তর করার মতো পর্যাপ্ত প্রশ্নব্যাংক সংবলিত বই হচ্ছে অনুশীলনমূলক বই। বর্তমানে নোট-গাইড নয়; বরং শিক্ষাক্রমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অনুশীলনমূলক বই প্রকাশ করছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো।  বিদ্যমান ব্যবস্থায় সনাতন ধারার নোট-গাইড তৈরি করা সম্ভবও নয়।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি (বাপুস) সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, এসব গ্রন্থ প্রকাশ ও বিক্রির সঙ্গে অন্তত ৮টি পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ২৩ লক্ষ ১০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। এই খাতে হয়েছে সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। এসব বইয়ের প্রকাশনা বন্ধ করা হলে সরকার একদিকে শত কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হবে, আরেকদিকে কর্মহীন হয়ে পড়বে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এ ধরনের সিদ্ধান্ত জনমনে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে।