অদক্ষ ও নিবর্তনমূলক কর ব্যবস্থাপনাই বাজেটের চ্যালেঞ্জ

জুন ৫, ২০২৪
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

 

ব্যাংক ও আর্থিক খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অপর্যাপ্ততার মধ্যে বৃহষ্পতিবার জাতীয় বাজেট আসছে জাতির জীবনে। সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রা্য় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট নিয়ে এবার তুলনামূলক আলোচনা কম এবং বোঝা যায় যে, মানুষ বাজেট নিয়ে তেমন কিছু ভাবছে না, তাদের কোন প্রত্যাশাও নেই বাজেট নিয়ে। সরকারও এবার কমই আলোচনা করেছে অংশীজনদের সঙ্গে।  সরকারের আয় কম, ব্যয় বেশি – দীর্ঘদিনের এমন এই সমস্যা এ বছর আরও প্রকট হয়েছে। সরকারের সামনে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ অনেক। তবে বাজেটের আসল চ্যালেঞ্জ হবে তিনটি। নিপীড়নমূলকভাবে করহার না বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির প্রবণতা ধরে রাখা, রাজস্ব ব্যয় সংকোচন করে উন্নয়নমুখী বিনিয়োগের সক্ষমতা বাড়ানো এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো।

বড় কাঠামোগত সমস্যা হলো সরকার পরিচালনার জন্য বিপুল ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না রাজস্ব আয়। এ কারণে জাতীয় বাজেটে বেড়েই চলেছে ঘাটতির পরিমাণ। আর সে জন্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিও হ্রাস পেয়েছে। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩১.১৭ শতাংশ। বাকি সময়ে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরেও শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির ৮৪. ১৬ শতাংশ বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছিল।

সরকার যে বাজেট দিচ্ছে তার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রতিবছরই হোঁচট খেতে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন বড় বাজেট, কিন্তু জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে অনেক কম। এবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার  হতে পারে,যা জিডিপির ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ। সাধারণত মধ্যম আয় বা উন্নয়নশীল দেশে বাজেটের আকার জিডিপির ২০ শতাংশের ওপরে থাকে। কোথাও কোথাও ২৫ বা ৩০ শতাংশও থাকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই অঙ্ক জিডিপির ৯.৬৮ শতাংশ। সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে কর আদায়ের লক্ষ্য হবে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই অঙ্ক জিডিপির ১০শতাংশের নিচে।

আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত আট বা সাড়ে আট শতাংশ যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আর করের অনুপাত জিডিপির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলে স্বস্তিকর বলা যেত। অর্থাৎ বাংলাদেশ বাজেটের আকার এবং কর-জিডিপির অনুপাত – এই দুই জায়গাতেই খুবই পিছিয়ে আছে। এগিয়ে যাবার কোন লক্ষণ নেই।

বোঝাই যাচ্ছে যে, আমাদের মূল সমস্যা কর ব্যবস্থাপনায়। ফলে কর কাঠামোতে বড় সংস্কার আনতে হবে, পেশাদারিত্ব বাড়াতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে, কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়াতে হবে, করের ভিত্তিকে বদলাতে হবে এবং করের অনুপাত জিডিপির ২০ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। আর সেটা নিয়ে যেতে পারলে বাজেটের আকারও জিডিপির ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আইএমএফ রাজস্ব খাতে সংস্কারের যে কথা বলেছে তার অন্যতম হলো আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং শুল্ক খাতে বছরের পর বছর যেসব কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা কমাতে হবে।

আমাদের অর্থনীতি বড় সংকটের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। এর বড় শিকার ব্যক্তিখাত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদোক্তারা। রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনার সংস্কারে বড় উদ্যম নিতে হবে কর নেটওয়ার্ক বাড়ানোতে। সহজ ও ব্যবসাবান্ধব আয়করব্যবস্থা না করতে পারলে শুধু চাপ দিয়ে বেশি কর আদায় মানসিকতা ভয়ংকর জুলুম।

সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে গতানুগতিক পন্থা অনুসরণ করছে। সেটা হলো ভ্যাটসহ পরোক্ষ কর বাড়ানো। এই ব্যবস্থা দরিদ্র বিরোধী, বড় লোক বান্ধব। রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ করের অবদান এরই মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রগতিশীল আয়কর ও সম্পদ কর আরোপ করে ধনীদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করতে না পারলে অর্থনীতিতে ন্যায্যতা আসবে না। বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকবে এবং আয় ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন হতে থাকবে।

রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারায় প্রতিবছর বাজেটে চেপে বসছে বড় অঙ্কের ঘাটতির বোঝা। আর এই ঘাটতি পূরণে সরকার দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে দেদারসে ঋণ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে,গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি উৎস থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৯ লাখ ৩২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা ধরে)। আর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। বাজেটের বড় অংশই বিপুল পরিমাণ এই ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে,শুধু সুদ পরিশোধেই আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা,যা চলতি বাজেটের চেয়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, দুর্নীতি কমানো সরকারের লক্ষ্য। সেটা করতে গেলে অনিয়মের বেড়াজাল থেকে ব্যাংক খাতকে নিয়ম ফেরানো, অতি জরুরি। এবং তার জন্য দরকার ক্ষমতা কাঠামো থেকে ব্যাংক লুটেরাদের প্রতি প্রশ্রয় বন্ধ করা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল