একটি গরম শিসার রাত

মার্চ ৫, ২০১৩

হও না সঙ্গছাড়া

মধ্যরাতের ফুটপাত বদলানোর মোহিনী ইশারাকে কখনোই উপেক্ষা করেনি শহর কলকাতা। চরাচরের কালো শামিয়ানার নিচে, সহজিয়া মধুশালার সুলুকে রাত-জাগানিয়া মন পথে নেমেছে বারে বারে। এখনও এলোমেলো হাওয়ার উজানে নেশাতুর ঠোঁটে এসে লাগে সেই আতুর আসবতৃষ্ণার গোলাপি ছোঁয়াচ। নিয়নের নিচে বিলোল বণিতার নয়নঠার আর রাত-আখড়ার ধোঁওয়ার ছবিতায়, শহুরে রাখালের যামিনী আড় ভাঙে। রতি-রাত আর পাপী চাঁদ যত আড়মোড়া ভাঙে, নিশাচরীর সঘন সঙ্গে দারুশালার বিচিত্র কথকতা গড়িয়ে যায় অন্য রাতকুঠুরিতে। রসিকা নগরীর পানশালা আর রাত ঠেকের সেই সব নিশিকথা-ই নিশিঠেক।

মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল… 

jadu_hai_nasha_h

দুই ঠোঁট ছিঁড়ে নাও,

চোখের কোটর থেকে নীলপদ্ম তুলে নাও,
নিষিদ্ধ দেরাজ থেকে টেনে নাও বক্র ছুরি- ছররা কাতুর্জ।

আখড়া থেকে বেরিয়ে রঞ্জার সঙ্গে হাংরি টাইডে বসে থাকতে থাকতেই সুদূর নিউ জার্সির উডব্রিজ থেকে উড়ে এল, বন্ধুনি জয়শ্রীর টেলিফোন। সঙ্গীতভবনের মেয়ে জয়শ্রীর সঙ্গে সখ্যতা শান্তিনিকেতনের খোকনদার সূত্রে। চির সবুজ খোকনদার কথা অন্য একদিনের নিশিঠেকে বলব। জয়শ্রী কলকাতার এক সরোদিয়ার কম্পোজিশনে কয়েকটা বাংলা গান রেকর্ড করেছে। যার সানন্দ প্রকাশ এই বসন্তে।

রঞ্জার গোলাপি হাসির চাহনিতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম, সে সিডির মুক্তি নিয়ে পিআর এজেন্সির সঙ্গে বৈঠক ছিল সদর স্ট্রিটে। জয়শ্রী যেহেতু প্রবাসে, বন্ধুতার দাবিতে, আমার উপস্থিতি চেয়েছে ও। ওর সব কিছুর মাঝখানে। কথা শেষ করে সেলটা জিন্সের গোপন গহ্বরে চালান করলাম। বুকের বোতামখোলা শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে রঞ্জাকে বললাম,

– যেতে হবে রঞ্জা। ঘন্টা তিনেকের বিরতি চাইছি ঠেক থেকে। জয়শ্রীর সিডি নিয়ে বসতে হবে এজেন্সির সঙ্গে। ভাগ্যিস জয়শ্রী মনে করিয়ে দিল। শিসার জন্য এরমধ্যে তুমিও চেঞ্জ করে নেওয়ার সময় পেলে বলো?

– হ্যাঁ সেটা দরকার ছিল। কিন্তু…

– কিন্তু কি? রাসবিহারী… না, প্রিয়া থেকে তুলে নেব তোমাকে ফিরতি পথে। এখন উঠি চলো, তোমাকে এখন ঘরে ফেরাই! ওই দেখো তোমার মুখে মনখারাপিয়া মেঘ!

– ভেবেছিলাম নিজেকে নিঃশেষ করে ‘কাঙাল হয়ে যাওয়ার সুখ-শান্তি’ নিয়ে ঘরে ফিরব। কিন্তু এমন হাওয়ার দিনেও তোমার ছুটি নেই! হয়তো নিরাপদ, তবু জানো ফকির…

– আচ্ছা রঞ্জা, মাত্র তিন ঘন্টার বিরাম!

– মাঝে মাঝে চমক লাগে সেদিনের বৃষ্টির মর্মর ছিঁড়ে তোমার সামিল সংবাদে। ‘এখনও বিস্ময় লাগে তোমার নিঃশব্দ আগমন।/ শুকনো নদী শুয়েছিল আকাশে তৃষ্ণার ঠোঁট মেলে হঠাৎ প্লাবন’।

রঞ্জার চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুব মনকেমন করল ওর জন্য। কেন যে আমারও এমন হয়! জানি, ও ঠিক বুঝতে পারে ভিতরে ভিতরে ওকে নিয়ে ফকিরের চির-বিহ্বলতা! নিমেষে পড়তে পারে, মনখারাপিয়া এই মনের রিমিক ঝিমিক শ্রাবণ! এখন মেঘের মতো ম্লান ওর মুখের আভা। যেন স্তব্ধতার প্রতীক। কাছে সরে এসে ছুঁই-ছুঁই দূরত্বে দাঁড়াল উড়ুক মেয়ে। তারপর দু’ হাতে ছুঁল! তুমুল হাওয়ার রাতে, প্রান্তরে দুটো গাছ যেমন পাশাপাশি দাঁড়ায়। একে অপরের পরম আশ্রয়ে পরস্পরকে যেমন ভালবাসে। আর হল্লাবাজ হাওয়ার ঝোঁকের অছিলায় একে অপরকে ছুঁতে চায়, তেমন করে ছুঁল ও! বাতাসে বিলাসিতা ভাসিয়ে ওর ঔদার্যে নতজানু হয়ে, ওকে শুভঙ্করের মতো করে বললাম,

– ‘কেন দিলে চাইতেই সাজানো বাগান হাতে তুলে?/ বহু বছরের হিমে ভিজে থাকা স্বরোদে হঠাৎ সুর গেল খুলে’। তোমাকে মাখতে ইচ্ছে করছে, এখন ভিতরে ভিতরে লুঠতরাজের হল্লা!

– উঁহুঁ! মোটেই না! দিনে-দুপুরে ডাকাতি করবে নাকি! রঘুডাকাত!

– তুমি তো জানো, ফকিরের যেমন তছনছিয়া স্বভাব।

– উফ! হৃদয়-দেহে সবের ভিতর আছ তো বাপু! তবু, ‘হও না সঙ্গছাড়া’।

– শক্তি চাটুজ্জ্যে? কোন কাব্য যেন?

– এমা এটা পড়নি! ‘মন্ত্রের মতন আছি স্থির’। পদ্যের নাম, ‘তোমায় ডাকা হয়নি’।

ট্যাক্সিতে নিবিড় করে জড়িয়ে নিতে ভাল লাগে রঞ্জাকে। স্পর্শের উদযাপনে ওর মধুর উপত্যকায় আঙুল ছোঁওয়ালে কানে এসে লাগে এস্রাজের মন্ময় ধ্বনি আর বৃন্দাবনী শ্রীখোলের দ্রিমি-দ্রিমি। ব্যাকসিটে ড্রাইভারের চোখ এড়িয়ে রঞ্জার দু’ চোখে লালি আদর দিয়ে দীর্ঘ চুমু খেতে খেতে মনে পড়ল তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘টুকরো কথার খই উড়ে যায়’-এর শেষ দুটো লাইন। ‘টুকরো কথার খই উড়ে যায়, উড়ে পুড়ে যায় আজ,/ কোথাও ঘাতক বাজিয়ে চলেছে নিরিবিলি এস্রাজ’!

২২ ক্যামাক স্ট্রিটের, আইভরি টাওয়ারের পাঁচতলায় কয়েক সপ্তাহ আগে এক বুধবার ছিল হিপহপ এবং হারিপ্পা নাইট আউট। ডিজে পুনিত এবং ডিজে বিভাস মিক্সড করছে নতুন কিছু হিপহপ এক্সপেরিমেন্ট বিটস। ভাংড়া তালে কোমর দোলানোর কথা বলতে বলতে রঞ্জাবতীকে ওর বাড়ির সামনে ড্রপ করে দিলাম। ও ধন্যবাদ জানিয়ে বিধ্বংসী হাসি হেসে কপট ঘোষণায় বলল,

– তেমন হলে আজ বরং বাতিল হোক হারিপ্পা নাইট আউট। নিশিঠেকে অন্য কোনও দিন যাই …

কাতর মিনতি সুরে আমি প্রার্থনার রেকাব পেতে বললাম,

– কী নিষ্ঠুর তুমি রঞ্জা! তোমার এমন রসিকতা… প্লিজ… লক্ষ্মীটি…

হাসির তরঙ্গে রঞ্জা বেসামাল। গমক সামলে রাজস্থানী বাঁধনির আঁচলকে শাসন করতে করতে মৃদু রহস্য আর আলগা ইশারায় দুষ্টুমির চোখে তাকাল। বলল,

– জলদি ভাগো তো দেখি ফকির… ঠিক তিন ঘন্টা কিন্তু, দেরি হলে আমি নেই নিশিঠেকে!

– পাক্কা! তুমি রেডি থেকো, ফিরছি…

এজেন্সির উদ্দেশ্যে সদর স্ট্রিটের পথে যেতে যেতে চোখ গেল মেঘের দিকে। দূর নীলিমায় বাসন্তিক মেঘের সুস্থিত বসতবাটি। কলকাতার গা পুড়ছে রুপোলি রোদে। শান্তিনিকেতনের পলাশতলিতে এইসময় চলছে নব বসন্তের উদযাপন। ওখানে মেঘ রাঙা হয় পলাশের রঙে। মনে পড়ল, আম্রকুঞ্জ আর বকুলবীথির মাঝের রাস্তায় একলা ফাগুনবউ গাছটার কথা। কলকাতার রাস্তায় ফাগুনবউ দেখিনি। গুটিকয় রুদ্রকিংশুক দেখেছি। শান বাঁধানো এ শহরে তো বসন্ত আসে নওল কিশোরীর বুকে, পাটিয়ালার ফ্লোরাল প্রিন্টে!

বসন্তের উজাড় মেঘ থেকে চোখ সরিয়ে হাতের ট্যাবে রাখলাম। এককথায় সু-শোভন শিসার ওয়েবপেজ। এ শহরে সেই কবে, উদ্বোধন হয়েছিল এই প্রথম হুকাবারটির। সেদিনও হাজির ছিলাম ওঁদের হৃদিক আহ্বানে। সেটা ছিল ২০০৮ সাল। শহরের সমৃদ্ধ মধুশালার শিরোপা এখন এই রাতকুঠুরির মাথায়। সান্দ্রলয়ের হাতছানি জাদুগীতের দোলনমায়ায় খুলে যাচ্ছে পানশালার ওয়েবের পরত। রাত্রিচর মায়াসুরের লয়কারিতে শিসার ওয়েবে ক্রমশ ডুবছি উদোম সুখের সন্ধানে। মায়া সুর-ফাঁক-তালে সাজানো সাইটে সুখ সরণি খুলে যাচ্ছে মিত আঙুলি স্পর্শে। সাত হাজার স্কোয়ার ফিটের ভিতর কী নেই!

এতদিন সারা শরীরজুড়ে রঞ্জা যে বায়না করে এসেছে, শিসা ঠিক তেমন ঋদ্ধ সন্ধান। এ সেই নিশিঠেক, যেখানে প্রত্যাশিত মধুশালার সব ওজর চুরমার হয়ে যায়। বেশ ভাললাগছে ওকে খুশি করতে পারব ভেবে। শিসায় প্রধান লাউঞ্জ ছাড়াও, রয়েছে থিমেটিক চাইনিজ বেড স্টাইলে কয়েকটি বুথ। এখানকার বুথগুলো নানা মুডে সাজানো। ত্রিশ থেকে একশো কুড়ি জনের বুকিং হয় লাউঞ্জ, কিন্তু বুথের বুকিং সাকুল্যে আট জনের। তবে কোনও একটি দল দুটো বুথের বেশি বুকিং পায় না। লাউঞ্জ বা বুথ বুকিং-এর জন্য সুনির্দিষ্ট ফর্ম রয়েছে।

শীলিত শিসার আকাশবিতানে রয়েছে ডেক। শিসার ডান্স ফ্লোর বা স্মোকিং জোনের থেকেও যা রঞ্জার বেশি প্রিয় জায়গা। রাজারহাটে সুইসোতেলের রুফটপ বা গড়িয়াহাটের কর্ন অ্যান্ড কাবাবের মতো ‘ডেক’-এ বসেও দিব্য কলকাতার দিগন্ত রেখায় চোখ রাখা যায়!

ট্রাফিকে লটকে রবিঠাকুর কানে এল, বসন্তের গান। ‘দখিন বাতাসে,/ প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে’। কবির ৬৯ বছর বয়সে লেখা ‘নবীন’-এর এই গানটা শুনলেই দোল দিনের গৌরপ্রাঙ্গন ভেসে ওঠে মনে। ভিড় করে এল মনের উঠোনে দোল-ফাগুনের রঙিন দিনের নানা স্মৃতি। ট্রাফিক খুলে গেল, ট্যাবের স্ক্রিনে শিসার সুখদার অলি-অন্দরে ঢুকলাম ফের, অলি যেমন বারবার ফিরে যায়-আসে সুবাসের মৌতাতে।

মধুশালার প্রতিটি দিন-ই বিশেষ শিসার কাছে। ফি শনিবার যেমন থাকে, ওল্ড স্কুল অ্যান্থেম, কমার্শিয়াল হাউজ, ওয়াইল্ড দেশি বিটস রিমিক্সড অথবা, হিপ হাউস! রবিবার খলিফা খুল্লমখুল্লার দিন, জাস্ট আনপ্লাগড সেশন। উদযাপনে একঘেয়েমি কাটাতে আবার সপ্তাহের মুদোয় বা শুরুর দুটো দিন, অর্থাৎ সোম আর মঙ্গলবার লাউঞ্জ বিটস বাঁধা থাকে ওল্ড স্কুল বা রেট্রো ক্লাসিকস-এ। বুধবার কিন্তু মুক্তমনা শিসার সান্ধ্যসুর ডাউন মেমোরি লেনে হাঁটে। শরীর ও মনের সাহসী সম্মেলনের হাত ধরে এদিন শিসার আবহে থাকে স্মৃতি জাগানিয়া কারোকে মিউজিক ট্র্যাক। শুক্রবার হিপ-হপের হুলিয়া! মখমল সুরে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ভিড়ের নিভৃতে দোলন-দোসর বদনামি বুটলেগস!

আবীর মুখোপাধ্যায়, বাংলাবাজার পত্রিকা।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.