কলকাতার ঐতিহ্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

আগস্ট ২৬, ২০১৩

v-bg20130825051715ঢাকা জার্নাল: বাঙ্গালি চিরকালই ভোজন রসিক আর ভ্রমণ পিপাসু। ভোজন ঠিক থাকলেও সময় বা সুযোগের অভাবে বিদেশ ভ্রমন হয়ে ওঠেনা। তাই যে সমস্ত পাঠক ভারতে বেড়াতে আসতে চান কিন্তু সময়ের অভাবে যেতে পারছেন না তাদের জন্য বাঙলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ চোখ দিয়ে ভারতের বিখ্যাত জায়গাগুলোর চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি ভাষ্কর সরদার। প্রথম কিস্তি তুলে ধরা হল-

কলকাতা: যে মুহূর্তে বিমানে ঘোষণা হয়, বিমান কলকাতার আকাশে প্রবেশ করেছে ঠিক সেই মুহূর্তে প্রবাস ফেরত প্রত্যেকটি কলকাতার মানুষ একবার অন্তত বিমানের জানলা দিয়ে দেখে নেবার চেষ্টা করেন তার প্রিয় শহরটিকে।

ককপিঠে বসে পাইলট বুঝে নিতে থাকেন বিমান বন্দরে অবতরণ করবার রানওয়েটি আর বিমানের ঐ যাত্রী সবুজে ঢাকা এই শহরের মধ্যে যে কয়েকটি জিনিষ স্পষ্ট দেখতে পান তার মধ্যে একটি হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ২০০ ফুট উচ্চতার সম্পূর্ণ মার্বেল-এর তৈরি এই স্মৃতি সৌধ ব্রিটেনের মহারানি অ্যালেস্কজেন্ডারিনা ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে নির্মাণ করা হয়।

কলকাতার প্রাণকেন্দ্র পার্ক স্ট্রিট`র সামান্য দূরে গাথিক শিল্পকলার আদলে চৌষট্টি একর জমির ওপর তৈরি এই স্মৃতিসৌধ শুধু মাত্র ব্রিটিশ মহারানির স্মৃতি বহন করে চলেছে তেমনটা নয়- বরং গোটা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের এক ধারাবাহিক ইতিহাসের সাক্ষর বহন করছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

ইতিহাসের নিরিখে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল
১৯০১ সালটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই বছরেই ব্রিটেনের কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়া স্বাধীনতা পায়। এই বছরেই নাইজেরিয়া ব্রিটিশ উপনিবেশে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবথেকে বড় ঘটনা ঘটে ১৯০১ সালের ২২ জানুয়ারি । এই দিনেই মৃত্যু হয় ইউনাইটেড কিংডম এবং আয়ারল্যান্ডের মহারানি অ্যালেস্কজেন্ডারিনা ভিক্টোরিয়ার।

সেই সময় ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড কার্জন। তিনি দেশবাসী ও দেশীয় রাজা এবং জমিদারদের কাছে মহারানির স্মৃতি সৌধ নির্মাণের ব্যাপারে মতামত চান। তারা সকলেই সহমত পোষণ করেন।

ব্রিটিশ বাস্তুকার উইলিয়াম এমারসনের ওপর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর নক্সা প্রস্তুতের ভার পড়ে। মহারাজা পঞ্চম জর্জ ১৯০৬ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উপ-মহাদেশীয় এবং ইউরোপীয় নির্মাণ শৈলীর মিশ্রণ দেখা যায় ভিক্টোরিয়ার গঠনশৈলীতে। অনেকেই ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে তাজমহল-এর তুলনা করেন।

১৯২১ সালে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এটি তৈরি করতে সেই সময় খরচ হয়েছিল এক কোটি পাঁচ লক্ষ ভারতীয় রুপি।

ভিক্টোরিয়ার মেমোরিয়াল ও ভিক্টোরিয়া নন্দনকানন
২০০ ফুট উঁচু এই স্থাপত্যের মাথার উপরে রয়েছে একটি ষোল ফুট উচ্চতার পরী। যার হাতে একটি ‘বিউগল’। বহু দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন আকাশের দিকে মুখ করে মেঘেদের দেশে গান শোনাচ্ছে এই পরী।

তিন টন ওজনের এই মূর্তিটি ইতালিতে তৈরি। গোটা স্থাপত্যকে ঘিরে রয়েছে একটি অপূর্ব সুন্দর বাগান। নানা ধরনের দেশি –বিদেশি গাছের সঙ্গে ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তের ভাস্করদের শিল্পকর্ম। ফুলের শোভা, সবুজের সমারহ আর নুড়ি পাথরের তৈরি রাস্তা।

রয়েছে ফোয়ারা। বিরাট দিঘি আর তাতে ফুটে আছে পদ্ম। সূর্য পশ্চিম পাড়ে রওনা দিলেই লক্ষ পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে উদ্যান চত্বর। বসন্তের অন্তিমলগ্নে শুরু হয় পরীইয়ায়ীদের আনাগোনা।

গত বছর কলকাতা সফরে আসেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। ২৬ মে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে তিনি বিশিষ্ট অতিথিদের মন্তব্যের খাতায় লিখেছিলেন- “আমি অভিভূত”।

রয়্যাল গ্যালারি
এই গ্যালারিতে আছে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের বিভিন্ন ছবি। আছে বিখ্যাত শিল্পীদের হাতে আঁকা অমূল্য প্রতিকৃতি। আছে মুঘল আমলের নানা নিদর্শন, আছে টিপুসুলতানের তরবারি থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলে হাতে লেখা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজ, চিঠি।

মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে ভারতের শাসকদের উদ্দেশ্যে লেখা মহারানি শেষ চিঠিটিও সযত্নে রাখা আছে এই গ্যালারিতে। আছে মহারানির ব্যবহারের চেয়ার, পিয়ানো বিবিধ জিনিষ।

এই গ্যালারিতেই আছে ব্রিটিশ আমলে ব্যবহার করা নানা রকমের অস্ত্র থেকে শুরু করে পোশাকসহ নানা দ্রষ্টব্য। এই প্রতিটি জিনিষ বহন করে চলেছে সময়ের ইতিহাস। এই সংগ্রহশালায় আছে ২৮,৩৯৪টি ঐতিহাসিক সামগ্রী- জানালেন ভিক্টোরিয়ার মেমোরিয়াল-এর সম্পাদক ও কিউরেটর ড. জয়ন্ত সেনগুপ্ত।

পাঠাগার
পাঠাগারে আছে বহুমূল্য বই, পত্রপত্রিকাসহ ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ। গবেষকদের কাছে এই পাঠাগার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশ বিদেশের বহু গবেষক এই পাঠাগারে এসে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

লেজার- এর আলোয় কলকাতার ইতিহাস
বিশেষ বিশেষ দিনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেখান হয় “লেজার শো”। লেজারের আলোয় উঠে আসে অতীতের কলকাতার জীবন্ত ছবি। শহরের বিবর্তনের এই ধারাবিবরণী কলকাতার এক বিশেষ আকর্ষণ।

দূষণ ও সংরক্ষণ
কলকাতায় বাড়ছে মানুষ আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। তারই প্রভাব পড়ছে ভিক্টোরিয়ার দুধ সাদা মার্বেল পাথরে। তাই বাধ্য হয়েই মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট সরকারকে বলেছেন সরিয়ে ফেলতে হবে কলকাতার সব থেকে বড় বাস স্ট্যান্ড। রক্ষা করতে হবে এই ঐতিহ্যকে।

কলকাতায় ঘুরতে গেলে কিছুটা সময় বার করে নিয়ে অবশ্যই হাজির হবেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। শুধু ইতিহাস নয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আক্ষরিক আর্থেই সময়ের অনুষঙ্গে ইতিহাস এবং দর্শনের সঙ্গে মিল ঘটেছে শিল্প এবং স্থাপত্যের। আর হয়ত এই কারণেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গোটা বিশ্বের ভ্রমণ মানচিত্রে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

ঢাকা জার্নাল,আগস্ট ২৬, ২০১৩

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.