দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সফল বাংলাদেশ

আগস্ট ২০, ২০১৩

01552601805_20130518000410রিফাত জাফরীন, ঢাকা জার্ন‍াল: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়টি যে কোনো দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। দুর্যোগকাল ও দুর্যোগপরবর্তী সময়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল হলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর জন্যও বাংলাদেশ একটি উদাহরণ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনন্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অগ্রবর্তী স্থান আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত।

বর্তমান সরকারের সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আরো শক্তিশালী এবং সমন্বিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। গৃহীত হয়েছে গ্রামীণ ও নগর ঝুঁকিহ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ।

দুর্যোগ প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান কার্যক্রমে এসেছে আরো বেশি সমন্বয়। অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) গ্রহণ করাসহ বাস্তবায়িত হয়েছে দুর্যোগপরবর্তী বিভিন্ন মানবিক সহায়তা কর্মসূচি।

বর্তমান সরকারের সময়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ প্রণীত হয়েছে। জারি করা হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা। দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী পরিমার্জন করে সময়োপযোগী করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে ন্যাশনাল প্ল্যান ফর ডিজাস্টার। সেইসাথে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিরও খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।

downloadগ্রামীণ ও নগর ঝুঁকিহ্রাসে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি নিরূপণ ও স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন বিষয় (আরসিএ গাইডলাইন) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৬০ লাখ গ্রামীণ বিপদাপন্ন মানুষের জন্য কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে উপকূলীয় ৯টি জেলায় দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পন্ড ও স্যান্ড ফিল্টার, গভীর নলকূপ স্থাপন, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপনের মাধ্যমে আইলা ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য পুনর্বাসন সহায়তা ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুলনায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দুর্যোগ সহনীয় মডেল গ্রাম। দেশের উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার জনগণের জন্য সুপেয় পানি প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় সুপেয় পানি ও লবণাক্ত এলাকার ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। সিসমিক রিস্ক এ্যাসেস্মেন্টের উপর প্রকৌশলী ও ভূতত্ত্ববিদদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ঢাকা চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে ঝুঁকি নিরসনে বিকল্প পন্থা এবং কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় কন্টিজেন্সি প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। নগর স্বেচ্ছাসেবক তৈরির লক্ষ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে ৬২ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়া দুর্যোগ প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান কার্যক্রমের আওতায় ইউনিয়ন ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের প্রস্তুতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস বিষয়ক পুস্তিকা বিতরণ এবং বিমানবন্দর নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) সম্প্রসারণ এবং ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে জাতীয় দুর্যোগ সাড়া প্রদান সমন্বয় কেন্দ্রে উন্নীত করা হয়েছে।

অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি’র) আওতায় চৈত্র-বৈশাখ মাসে কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ব্যতিক্রমী কর্মসূচির মাধ্যমে মঙ্গাপীড়িত জেলায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কর্মহীনদের জন্য ৮০ দিনের কর্মসংস্থান প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুস্থ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তাৎক্ষণিক নগদ সহায়তা বা জিআর ক্যাশ হিসেবে ২২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তির অসচ্ছল পরিবারকে জিআর চাল সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় এ পর্যন্ত ১ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। দুর্যোগে আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত গৃহনির্মাণে সহায়তা প্রদানের জন্য ব্যক্তি বা পরিবারকে ঢেউটিন বিতরণসহ গৃহনির্মাণ মঞ্জুরী সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৯৩ হাজার বান্ডিল ঢেউটিন এবং ১২৩ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। কম্বল বিতরণ কার্যক্রমের আওতায় এ পর্যন্ত ১০ লাখ পিস কম্বল এবং ১০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় ও পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রমে দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার আওতায় দেশের ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শিক্ষাকোর্স ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রফর্মা গাইডলাইন সংশোধনের মাধ্যমে সকল মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন (ডিআর/সিসিএ) কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় এ পর্যন্ত ৭৪টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণসহ সমতল গ্রামীণ এলাকায় ২০৭৩টি ছোটো সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য গ্রামীণ এলাকায় জলবদ্ধতা হ্রাস ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৩২৩টি সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। সারাদেশে ৭২৪টি ঘূর্ণিঝড় সহনীয় ব্যারাক হাউজ নির্মাণ করাসহ ৬৯ কোটি টাকার উদ্ধারকার্যে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ৮৮টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণসহ ৬৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র এবং সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে। মোবাইল ফোনের ‘সেল ব্রডকাস্টিং’ প্রযুক্তির মাধ্যমে সতর্ক সংকেত এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। চাহিদানুযায়ী দুর্যোগের আগাম আবহাওয়া বার্তা টেলিটক ইন্টার-অ্যাকটিভ ভয়েস রেসপন্স (আইভিআর) এর মাধ্যমে দেশের সকল জেলা-উপজেলায় প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

কাজেই আশা করা যায়, একটি শক্তিশালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ অচিরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে একটি সফল রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর এ জন্য সরকারের পাশাপাশি প্রয়োজন আমাদের সকলের সচেতনতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ। – পিআইডি ফিচার,

ঢাকা জার্ন‍াল, আগস্ট ২০, ২০১৩।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.