‘শেষ গুলিটা লাগে মাজায়’

ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৩

Harun-FreedomFighter-220121020090147এস এম আববাস, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: একাত্তরের ১১ নভেম্বর ভোর রাত। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীতে একটি অপারেশনে যেতে জালালপুর গ্রামের গোপন রাস্তায় হাঁটছি। এমন সময় গুলির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ।

আমরাও প্রস্তুত। অন্ধকারের মধ্যে শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পালাবার পথ খোঁজে। ঠিক সে মুহূর্তে একটি গুলি লাগে আমার ডান হাতে।

অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়ি। মুহূর্তেই আরো দু’টি গুলি ছুটে আসে। একটি গুলি মাথার চামড়া তুলে নিয়ে যায়। তার পরেও সাহসের সঙ্গে এগুতে থাকি। হয় বিজয়, নয় সম্মুখ যুদ্ধেই মৃত্যু। এরপর শেষ গুলিটা এসে লাগে মাজায়। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি।

সহযোদ্ধাদের কয়েকজন আমাকে সীমানা পেরিয়ে নিয়ে যান ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের বাগডোরা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর নিয়ে যাওয়া হয় শিলিগুড়ি হাসপাতালে।

একহাতে চায়ের কাপ আর অন্য হাতে কেটলি ধরে চা ঢালার ফাঁকে ফাঁকে বলতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধা মো. খলিলুর রহমান।

মোহাম্মদপুরে শিয়া মসজিদের মোড়ে টেম্পু স্ট্যান্ডের কাছে ফুটপাতে চায়ের দোকান তার। সকালে রাজধানীতে লোক চলাচল শুরুর পর থেকে দোকান খুলে বসেন খলিল। গভীর রাত পর্যন্ত স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে চা বিক্রি করেন।

যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা নানা কষ্ট ও সুখকর অনভূতির কথা বলেন বাংলানিউজকে। অনুযোগের সুরে বলেন, “দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা উদ্যানের পাশে সরকারি খাস জমিতে বসবাস শুরু করি।”

১৯৮৩ সালে ১ জানুয়ারি বিডিআর থেকে অবসরের পর পেনশনের ৯ হাজার ৯৯৯ টাকা খরচ করে মাথাগোঁজার ঠাঁই তৈরি করি ঢাকা উদ্যানের পাশে, সরকারি জমিতে। কিন্তু পরে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ভাড়া বড়িতেই রাজধানীর সাত মসজিদ হাউজিংয়ের জীর্ণ বাসায় জীবন-যাপন আমার। আর বঙ্গবন্ধুর দেওয়া টিন দিয়ে তৈরি ঘরে কুমিল্লার গুনাইঘর গ্রামে পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন।”

মুক্তিযুদ্ধের ৬ নম্বর সেক্টরের ‘এ’ কোম্পানির ১ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মো. খলিলুর রহমান। একাত্তরে ইপিআর-এ জওয়ান হিসেবে চাকরি করতেন তিনি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের একটি অংশ শুনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হন দেশপ্রেমিক এই মানুষটি।

খলিলুর রহমান বলেন, “বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি আর তোমাদের হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়েই প্রস্তুত থাকো। শত্রুর মোকাবেলা করো।”

খলিল বলেন, “এরপরে আর বসে থাকতে পারিনি। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কক্সবাজার ইপিআর থেকে আগরতলার মেলাঘর পালাডনা যাই। আগরতলায় ‘এ’ কোম্পানির ৭৫ জনকে ট্রেনিং করাই। এরপর আগরতলা থেকে ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর নেতৃত্বে ভারতের তুরা যাই। সেখানে দু’দিন অবস্থানের পর রংপুরে ৬ নম্বর সেক্টরে যোগ দেই। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর নওয়াজিস। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মতিউর রহমান। ইপিআরের সুবেদার আলতাব হোসেন ছিলেন সহকারী কোম্পানি কমান্ডার। এদের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানির ১ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে দায়িত্ব পালন করি।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা কষ্টের মধ্যেও সুখকর অভিজ্ঞতার কথা বলেন তিনি। শিলিগুড়ি হাসপাতালে জেনারেল এমএজি ওসামানী তাকে দেখতে যান। তার খোঁজ-খবর নেন। ফেরার সময় হাতে ৫শ’ টাকা উপহার দেন তাকে। সম্মুখ যুদ্ধে সাহসিকতার জন্যই তাকে উপহার হিসেবে টাকাটি দিয়েছিলেন বলে জানান যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা খলিল বলেন, “যাওয়ার সময় ওসমানী বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হবে, তোমরাও সুস্থ হবে।”

খলিলুর রহমান জানান, শিলিগুড়ির হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেন ওসমানী। তার নির্দেশনা মতো আমাদের লখনৌতে বিএসএফ কমান্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে সাক্ষাৎ হয় কর্ণেল খালেদ মোশারফের সঙ্গে। তার মাথায় গুলি লাগার পর অসুস্থ হয়ে তিনি চিকিৎসা নেন সেখানে।

মুক্তিযোদ্ধা খলিল বলেন, “আমরা থাকতাম জেসিও ওয়ার্ডে। আর খালেদ মোশাররফ থাকতেন অফিসার ওয়ার্ডে। তিনি প্রতিদিন বিকেলে আমাদের ডেকে নিয়ে সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা বলতেন। প্রতিদিন বিকেলে আমাদের নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কনফারেন্স করতেন।”

লখনৌতে চিকিৎসাকালীন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা আরো বলেন, “ওই সময় হাসপাতালে আমাদের দেখতে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। আমাদের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার জন্য একটি করে সনদ এবং একটি থ্রি-ব্যান্ড রেডিও উপহার দেন মুক্তিযোদ্ধাদের।”

খলিল জানান, দেশ স্বাধীনের পর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা দেখা করি। বঙ্গবন্ধু আমাদের চিকিৎসা ও অভাবের কথা জেনে প্রত্যেককে পাঁচ হাজার করে টাকা তুলে দেন। তিনি বলেছিলেন ‘সব ব্যবস্থা হবে।’

ওই বক্তব্যের রেশ ধরে আক্ষেপের সুরে খলিল বলেন, “বঙ্গবন্ধু নেই। কোনো ব্যবস্থাই আর হয়নি।”

চা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা বলতে থাকেন তার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা।

তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকের কথা। যুদ্ধে আমাদের জয় নিশ্চিত। পাকিস্তানি বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমরাও পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি খুঁজে খুঁজে অপারেশন চালাচ্ছি ক’দিন ধরে। বিপদ বুঝলেই দহগ্রামে আশ্রয় নেই। আর সুযোগ বুঝে আক্রমণ চালাই পাক বাহিনীর ওপর।”

মুক্তিযোদ্ধা খলিল বলেন, “ভুরুঙ্গামারীর জালালপাড়ায় সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমি ছাড়া জালালপুরের সম্মুখ যুদ্ধে স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতা আহত হন। বাকিরা সবাই সুস্থ ছিলেন ওইদিন পর্যন্ত। তবে পাকিস্তানীদের ৭০ থেকে ৭৫ জন সৈন্য মারা যান। এটি ছিলো আমাদের বিশাল বিজয়।”

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে নিজের কোন হতাশা নেই তার।

তিনি বলেন, “শুধু মনে হয়, আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। মানুষের দু:খ কষ্ট দেখার কেউ নেই। বঙ্গবন্ধু থাকলে এমনটি হতো না।”

মুক্তিযোদ্ধা খলিল জানান, চা বিক্রি করে সংসার চালানোকে কোনো অসম্মানের কাজ বলে মনে করেন না তিনি। পরিশ্রমের চেয়ে অন্য কিছু বড় করে দেখার মধ্যে আনন্দ নেই তার। কাজের মধ্যে থাকতেই তার ভালো লাগে। তবে এই চা বেচে সংসার চলে না। পেনশনের ১ হাজার ৫২৮ টাকায় বাড়িভাড়া দেওয়া হয় না। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা দেয় সরকার। আর চা বেচে যা আসে তা দিয়েই পুরো সংসার চালাতে হয় তাকে। পরিবারের ৮ সদস্যের চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচ মেটানো যায় না।“ তাই স্ত্রী সালেহাকে নিয়েই চায়ের দোকান দিয়ে উপার্জন করি।“

তিনি বলেন, “সামান্য টাকায় সংসার চালানো ও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পরি না। আর সে কারণে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। গত বছর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সারা দেশের ১৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা দিতে তালিকা পাঠিয়েছে সরকারের কাছে। ওই তালিকায় চট্টগ্রাম বিভাগের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৫ নম্বরে আমার নাম রয়েছে।”

খলিল বলেন, “ঢাকা উদ্যানের পাশে সরকারি যে জায়গায় জীবনের শেষ নগদ অর্থ দিয়ে ঘর তৈরি করেছিলাম তা ভেঙে নিতে হয়েছে। এখন ওই জায়গাটি দখল করে আছে স্থানীয় এক প্রভাবশালী। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক কথা দিয়েছিলেন বাসস্থানের একটা ব্যবস্থা হবে, আজো হয়নি। আর যুদ্ধাহত হিসেবে ভাতাও পাচ্ছি না।”

তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দ তাকে আজো সুস্থ রেখেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান।

বাংলাদেশ সময় : ১৮৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১২

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.