যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে আ’লীগ সাংসদের ডিও লেটার
ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৩ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে উল্টোরথে চড়ে সিন্দাবাদের মতো ব্যবসায় নেমেছেন খোদ আওয়ামী লীগেরই একজন সংসদ সদস্য।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সংসদ সদস্য এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতাদের। তারা জানান, আদর্শিক রাজনীতি করতে নয়, ব্যবসা করতেই মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন তিনি।
নেতাদের অভিযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে অর্থ আদায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাল বিক্রি করে লুটপাট এবং ডিও লেটার বিক্রিসহ নানাভাবে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছেন আব্দুল ওয়াদুদ দারা। আর এ কারণে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই মানবতাবিরোধী অপরাধী ও জামায়াত নেতাদের ডিও দিয়েছেন তিনি।
এসব অভিযোগ বিষয়ে রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সংসদ সদস্য কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার কাছে জানতে চাইলে শনিবার দুপুরে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, “এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নেই।“ অভিযোগের বিষয় উল্লেখ করে তার কাছে স্পষ্ট বক্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, “যা পেয়েছেন লিখে দেন।“
দুর্গাপুর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা আব্দুল কাদের মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, “৫০ হাজার টাকা ছাড়া কাউকে ডিও দেন না এমপি সাহেব। দুর্গাপুরের তৎকালীন পিস কমিটির চেয়ারম্যান এবং এই এলাকায় একাত্তরে গণহত্যার নেতৃত্বদানকারী মোল্লা আব্দুল ওয়াহেদকে ডিও দিয়েছেন মোটা অংকের টাকা নিয়ে। এছাড়া পৌর জামায়াতের সভাপতি নুরুজ্জামান লিটনের নতুন প্রতিষ্ঠিত একটি কারিগরি স্কুল অনুমোদনের জন্যও ডিও দিয়েছেন মোট অংকের টাকা নিয়ে।“
যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে উল্টোরথে চড়ে সিন্দাবাদের মতো ব্যবসায় নেমেছেন এমপি দারা। রাজনীতি করতে নয়, ব্যবসা করতেই মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি দুর্গাপুর ডিগ্রি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে জামায়াতের সদস্য আব্দুল আজিজকে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন বলেও দাবি করেন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের।
আব্দুল কাদের মণ্ডল আরও বলেন, “দুর্গাপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজশাহী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের সভাপতি আ ন ম নুরুল আলম হিরু মাস্টারের ছেলে বাকিউল আলম লিটনকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধী মোল্লা আব্দুল ওয়াহেদকে টাকার বিনিময়ে সভাপতি করতে সংসদ সদস্য ডিও দিয়েছেন।“ তিনি জানান, হিরু মাস্টারের ছেলে লিটন উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংসদ সদস্য কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি মোল্লা আব্দুল ওয়াহেদকে একটি স্কুলের সভাপতি মনোনয়ন দিতে ডিও দেন। উপজেলার মাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির মনোনয়ন চেয়ে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেন ওই ডিওতে।
গত ১৩ মে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে দেওয়া ডিও লেটারে বলা হয়েছে, “দুর্গাপুর উপজেলার কিসমত মাড়িয়া গ্রামের মোল্লা আব্দুল ওয়াহেদকে মাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য প্রধান শিক্ষক আবেদন জানিয়েছেন। এ অবস্থায় রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন প্রদানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করছি।“
মাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনসার আলী বলেন, “মোল্লা আব্দুল ওয়াহেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলা রয়েছে। তাকে সভাপতি হিসেবে নেওয়ার জন্য সংসদ সদস্যের কাছে আমি আবেদন করিনি।“ তিনি অসহায়ের মতো বলেন, “আবেদন করে ডিও চাওয়া লাগে না। এমনিতেই পাওয়া যায়। যারা প্রতিষ্ঠান চালান, তারা চাইলে আমার কী করার আছে?“
পুঠিয়ার বানেশ্বর ইসলামিয়া কলেজের সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সাত্তার শেখ বিষয়টি স্বীকার করলেও এমপির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যাবে না বলে জানান। তবে তিনি নিশ্চিত করেন দুর্গাপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মোল্লা আব্দুল ওয়াহেদের নামে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দুর্গাপুর থানায় মামলা হয়। মোল্লা ওয়াহেদকে এক নম্বর আসামি করে ১১ জনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ২১ এপ্রিল হোজা অনন্তকান্দি গ্রামের আলিমুদ্দিন নামের এক ব্যক্তি মামলা করেন। আলিমুদ্দিন মারা গেছেন বলেও জানান তিনি।
পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, “যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তাকে ডিও দেওয়া আওয়ামী লীগের জন্য কলঙ্কজনক। আমরা এমনটি আশা করিনি। মোল্লা ওয়াহেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারে রয়েছে।“ মামলাটির তদন্তও চলছে বলেও জানান তিনি।
এস এম আববাস, ৯ জুন ২০১২।