দোকানে বিস্ফোরণ : ফুটপাতে বিচ্ছিন্ন মেধাবীর পা

জানুয়ারি ২১, ২০১৩

রাজধানীর রাজপথে হাঁটছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে রাস্তায় গড়িয়ে পড়েন রানা। থেতলে যায় মাথার এক পাশ। জীবন রক্ষার প্রয়োজনে ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করেন। কিন্তু সে শক্তি তখন আর অবশিষ্ট নেই। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বাম পা।

মধ্যবাড্ডার মোল্লাপাড়ার ব্যস্ততম রাস্তায় হেঁটে বাসায় ফেরার পথে এ অবস্থার শিকার হন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বিবিএ দ্বিতীয় সেমিস্টারের মেধাবী ছাত্র মেহেদী হাসান রানা।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই শরীর থেকে একটি পা বিচ্ছিন্ন। এটি কি করে মেনে নেবে উন্নত জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে রাজধানী শহরে ছুটে আসা রানা!

নিজের পা হারানোর কষ্টের চেয়েও বড় কষ্ট, স্কুল শিক্ষক বাবার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিসিটির বিবিএ’র ছাত্র মেহেদী হাসান রানা গত ৯ জানুয়ারি দুপুরে হেঁটে ফিরছিলেন বাসায়। মোল্লা পাড়ায় বীর উত্তম রফিকুল ইসলাম সরণীর ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি।

হৃদয় স্টিল কিং নামের দোকানে লেদ মেশিনে একটি কেমিক্যালের ড্রাম কাটা হচ্ছিল ওই সময়। এরই এক পর্যায়ে কেমিক্যালের ড্রামটিতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ড্রামের একটি বড় অংশ বুলেটের গতিতে ছুটে এসে আঘাত হানে রানার বাম পায়ে। সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পা। এখানে শেষ নয়, ড্রামের কাটা অংশ বাম পা বিচ্ছিন্ন করে এসে লাগে ডান পায়ের হাঁটুর নিচে। মাংসপেশি কেটে যায় ডান পায়েরও।

মর্মান্তিক এ দৃশ্য দেখেই বাড্ডা থানা পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) সোমেন বড়ুয়া ছুটে যান রানার পাশে। নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে একটি গাড়ি ভাড়া করে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পা হারালেও অন্তত: প্রাণে বাঁচেন মেধাবী এই ছাত্র।

রানার বাবা বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ উপজেলার খালকুলা গ্রামের স্কুল শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস। দৈবঘাটি আদর্শ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন থেকেই সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস বাংলানিউজকে জানান, ছেলেকে বিবিএ পড়ানোর জন্য রাজধানীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে রাজধানীতে পাঠান তিনি। ভর্তিও হন রানা। বাড্ডায় চাচা বাবুল হালদারের বাসায় থেকে মহাখালীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেন।

স্কুল শিক্ষক বাবা জানান, সামান্য উপার্জনের সব অর্থ ছেলের পেছনে ব্যয় করতে হলেও তার স্বপ্ন বিবিএ পড়াবেন, প্রয়োজনে আরো উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে ছেলেকে নিজের পায়ে দাঁড় করাবেন। কিন্তু ছেলের এ অবস্থায় সে আশার গুঁড়ে বালি। সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তার।

জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতল) পি-৫৮ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন রানা। সন্তানের সুস্থতার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন স্কুল শিক্ষক বাবা।

গত ১১ জানুয়ারি সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে ওই শিক্ষক আক্ষেপ করে বাংলানিউজকে জানান, সন্তানের এমন অবস্থায় স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তার।

তিনি জানান, রানা রাজনীতি করে না। সব ধরনের ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে ব্যস্ত থাকে পড়ালেখায়। অথচ আজ পা হারিয়ে পঙ্গু হতে হল তাকে।

নিজের সন্তানের এই করুণ পরিণতি দেখে আর সব বাবা সম্পর্কেও দু:খ চেপে সুখ প্রত্যাশা করেন আব্দুল কুদ্দুস।

সবার জন্য তার শুভ কামনা, “কোন সন্তানকে এমনভাবে যেন আর পা না হারাতে হয়। কোন বাবা যেন আমার মতো অহসায় পরিস্থিতিতে না পড়েন।”

স্কুল শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস বাংলানিউজকে আরো বলেন, “গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততম রাস্তায় খোলামেলাভাবে লেদ মেশিনে ড্রাম কাট হবে। আর দেখার কেউ থাকবে না, এমনটি হতে পারে না।”

রাজধানীর যত্রতত্র চলা এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বন্ধ করতে প্রশাসনকে শক্তভাবে ব্যবহারের অনুরোধ জানান তিনি। এসব অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও জোর দাবি জানান ছেলের পা হারানোর ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পিতা।

দোকান মালিক গ্রেফতার
রানা আহত হওয়ার পরদিন ১০ জানুয়ারি চাচা বাবুল হালদার অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর ১৮) বাড্ডা থানায়। তবে যে দোকানে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই দোকানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে ই-৮/৩ হৃদয় স্টিল কিং দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা ড্রামটি কাটার সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে তার বাম পা হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিভৎসতা ছড়িয়ে পড়ে থাকে ঘটনাস্থলে।

ঘটনার দিন উদ্ধারকারী পুলিশের এসআই সোমেন বড়ুয়ার সঙ্গে শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “মর্মান্তিক ঘটনার জন্য অপরাধী দোকান মালিক নজরুল ইসলাম ও কর্মচারী আব্দুস সামাদকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।”

এস এম আববাস

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.