রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র: লাভ-ক্ষতির হিসেবে গড়মিল

মে ১, ২০১৩

Coal-power-station-001ঢাকা জার্নাল: বাগেরহাটের রামপালে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে দেশের লাভ না ক্ষতি, সে হিসেব মিলছে না৷ বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি দেশের মানুষও এখন দু’ভাগে বিভক্ত৷

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যেভাবে এটি করতে চাইছে তাতে ধ্বংস হবে সুন্দরবন আর পরিবেশে নামবে বিপর্যয়৷ সঙ্গে আর্থিক ক্ষতি তো আছেই৷

সরকার কিন্তু দিচ্ছে পাল্টা যুক্তি৷ তারা বলছে, বিদ্যুৎ দিতে না পারলে সাধারণ মানুষের ধোলাইয়ের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরাও কমে ছাড়েন না৷ বিদ্যুত্‍ কেন্দ্র নির্মাণ করতে গেলে বিশেষজ্ঞদের যত আপত্তি৷ আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবন-পরিবেশ – কিছুরই যাতে সমস্যা না হয়, সে দিকে গভীরভাবে নজর রাখা হচ্ছে৷ এই বিতর্কের মধ্যেই সরকার ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে চুক্তিও করে ফেলেছে৷

রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য গত ২০ এপ্রিল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিনটি চুক্তি হয়েছে৷ চুক্তির মধ্যে রয়েছে – যৌথ উদ্যোগ চুক্তি, বাস্তবায়ন চুক্তি ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি৷ ২০১১ সালের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়, তাতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালনের বিষয়টি ছিল৷ এরপর রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্‍ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের শুরুতে ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)৷

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘‘পরিবেশ দূষণ ও প্রতিবেশ যাতে নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে সর্তক থেকেই রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্‍ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷” বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লা দিয়ে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্‍ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে৷ তারই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে৷

ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরুপ রায় চৌধুরী বলেন, এটি ভারতের বাইরে এনটিপিসির সবচেয়ে বড় উদ্যোগ৷ তাই এটি তাদের কাছে খুবই উল্লেখযোগ্য একটি প্রকল্প৷ ২০১৮ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে বলে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে৷ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি’ নামে একটি কোম্পানিও গঠন করা হয়েছে৷

তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, রামপালে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে পরিবেশে৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশকে রক্ষার প্রাকৃতিক বর্ম বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবণ৷ সুন্দরবন রক্ষার প্রশ্নে কোনো ছাড় দিয়ে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে পারে না বলেও দাবি করেন তিনি৷

আনু মুহাম্মদ বলেন, খুলনা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবিদরা একটি সমীক্ষা করে দেখিয়েছেন, রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের কি পরিমাণ ক্ষতি হবে৷

তিনি বলেন, “বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সুন্দরবন এলাকার বাতাসে ক্ষতিকারক সালফার ও নাইট্রোজেনের মাত্রা বর্তমানে প্রতি কিউবিক মিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম রয়েছে৷ বিদ্যুত্‍ কেন্দ্র হলে ঘনত্ব ৫৩.৪ মাইক্রোগ্রামে গিয়ে ঠেকবে৷ এর পরিণতি হিসেবে বিপন্ন হয়ে পড়বে সুন্দরবনের অস্তিত্ব৷ তাই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে আমাদের লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হবে৷”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (পবা) অন্যতম নেতা ইকবাল হাবিব বলেন, পরিবেশের প্রভাব নিরূপনের (ইআইএ) আগেই পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে সরকার সাধারণ মানুষের জমি দখল করে নিয়েছে৷

তিনি বলেন, শীতের সময় উল্টোদিকে বাতাস বয়ে যায়৷ তখন সুন্দরবন থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই ও ধোয়া সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি করবে৷ এতে সুন্দরবনে থাকা জীবজন্তুরও ক্ষতি হবে৷

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে একটা রিট রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রিট থাকা অবস্থায় একের পর এক চুক্তি করে সরকার আইন ভঙ্গ করেছে৷ তাই সবকিছু পলিটিক্যালি বা টেকনিক্যালি না দেখে জনগণের কথাও ভাবা উচিত৷

তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি’-র পরিচালক আবুল কাশেম  বলেন, শুধু বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা করলে তো আর হবে না৷ সরকারের বিষয়টিও অন্যদের বিবেচনায় নিতে হবে৷ বিদ্যুৎ দিতে না পারায় সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত সরকারকে ধোলাই করছে৷ আর বিশেষজ্ঞরা তো আছেনই৷ সুন্দরবনের যে ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়৷

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে তা সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে৷ আর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে চুল্লি থাকবে তা ২৭৫ মিটার উঁচুতে৷ তার মুখ সুন্দরবনের দিকে নয়, উল্টোদিকে রাখা হবে৷ এত উঁচুতে চুল্লির মুখ থাকায় কোনো ধোয়া বের হলেও তা প্রভাব সুন্দরবনে পড়বে না৷

তিনি বলেন, আমাদের দেশে ২/৩ বার নিম্নচাপ হয়৷ আর এই নিম্নচাপ আসে বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে৷ তাই এই নিম্নচাপে ধোয়া হিমালয়ের দিকে চলে যাবে৷ আর এখানে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে৷ এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা কম লাগবে৷ যাতে পরিবেশের দূষণও কম হবে৷ আর এই টেকনোলজিতে কোনো ধোয়া বের হয় না৷

তাই সুন্দরবনের দিকে ছাই বা ধোয়া যাওয়ার যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা ভুল প্রমাণিত হবে৷ তাছাড়া পরিবেশের প্রশ্নে একটি উচ্চ পর্যায়ের যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে মনিটরিং করা হবে বলে মন্তব্য করেন আবুল কাশেম।

আবুল কাশেম আরো বলেন, ‘‘বর্তমানে দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের বড় অংশ আসছে তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে৷ যার উৎপাদন খরচ অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি৷ তাই জ্বালানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দেশে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব বাড়ছে৷ সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ভারতের সঙ্গে এই চুক্তি করা হয়েছে৷ তাই এই চুক্তি বাস্তায়ন হলে আমাদের লাভই বেশি হবে৷”

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.