মিডিয়া ট্রায়াল নয়, আগে তদন্ত হোক

ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪

মাসকাওয়াথ আহসান।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ঘটনাটির কোনো আনুষ্ঠানিক তদন্তের আগেই শুরু হয়ে গেছে মিডিয়া ট্রায়াল।
নাদির জুনাইদ বেশ ভালো ছাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে আমাদের বিতর্ক সংগঠনের সদস্য ছিলেন। অনেকদিন যোগাযোগ নেই।বছর দশেক আগে অমর একুশে গ্রন্হমেলায় দেখা হয়েছিলো। কয়েক বছর আগে ফেসবুকে আমি আমার মিডিয়া স্টাডিজ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে একবিংশের টিচিং মেথড সম্পর্কে দুটি কথা লিখলে একটি তিক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলো। এতে আমার একটু মন খারাপ হলেও সে অনুজপ্রতিম; তাই দূর থেকে শুভাকাঙ্খী হিসেবে রয়ে যায়।

নাদিরের বিরুদ্ধে যে ছাত্রীটি অভিযোগ করেছে তার বক্তব্য শুনেছি। সে এক্সসেপশনালি ইন্টেলিজেন্ট একটি মেয়ে। তার ভবিষ্যত সাফল্য খুব আশাপ্রদ। সাংবাদিকতা বিভাগের উচিত হবে; তার  অ্যাকাডেমিক ফলাফলে কোনো আন্ডারমার্কিং হয়ে থাকলে খাতা আবার দেখে ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তার যোগ্যতার মূল্যায়ন করা। নতুন প্রজন্মের মেধা লালন আমাদের কর্তব্য।

নাদির পশ্চিমে পাঠ নিয়েছেন। সেখানে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেলামেশা করেন। এটা খুব প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। নাদিরের অক্সিডেন্টাল শিক্ষকতা মেথডের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের ওরিয়েন্টাল জানাশোনার একটি ক্ল্যাশ ঘটে থাকতে পারে।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি পশ্চিমাদের সঙ্গে যেভাবে মিশি প্রাচ্যের কারো সঙ্গে সেভাবে মিশি না। তবে ক্লাসরুমে পশ্চিমা সমাজের সাবলীল ও সহজ সংস্কৃতি সম্পর্কে বলি।

আমি ইউরোপে পশ্চিমা নারী সহকর্মী ও আমার সংগে যুক্ত ইনটার্নদের সঙ্গে যেভাবে মিশেছি; দক্ষিণ এশিয় নারী সহকর্মী ও ইনটার্নদের সঙ্গে একটু সোনালি দূরত্ব রেখে মিশেছি।

নাদির হয়তো পূর্ব-পশ্চিম সব জায়গার মানুষের সঙ্গে একভাবে মেশে। শিক্ষক হিসেবে নম্বর দেবার ক্ষেত্রে বেশ স্ট্রিক্ট। কিন্তু আজকালকার কিছু ছাত্রছাত্রী বিনা প্রস্তুতিতে ভালো গ্রেড আশা করে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়নে তারা কম নম্বর দেয় নিজের খারাপ গ্রেড আসার প্রতিশোধ হিসেবে।

জেন্ডার স্পর্শকাতরতা খুব জরুরি বিষয় । কিন্তু যত্রতত্র জেন্ডার কার্ড প্লে করার একটি অপচর্চাও রয়েছে। আমাদেরকে যে কোনো ঘটনায় জাত গেল জাত গেল প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে কোনো ঘটনার নৈর্ব্যক্তিক তদন্ত করতে শিখতে হবে।

আমার নিজের জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সঙ্গে কালচারাল ডিফেরেন্সের ক্ল্যাশে আন্ডার মার্কিং এর ঘটনা ঘটেছে। অতীতে ম্যাডামের ওপর ক্ষোভ ছিলো। কিন্তু এখন মনে হয় উনি অসহযোগিতা না করলে হয়তো আমার জীবন এমন বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হতো না। তাই জীবনের কোনো ঘটনাতেই ভাবতে নেই যে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো। ছাত্রছাত্রীদের মনে রাখা দরকার, আজকাল গ্রেডের ওপর চাকরি নির্ভর করে না। এইচ আর দেখে মানুষ হিসেবে প্রার্থী কেমন।

মানুষ হতে গেলে আত্মজিজ্ঞাসার মাঝ দিয়ে যেতে হয়। ভেবে দেখতে হয়, কোনো ঘটনায় আমি যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি কীনা? শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্ক হতে হবে সত্য সুন্দর আর মঙ্গলের ওপর ভিত্তি করে। নাদির আর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা ছাত্রী উভয়েই সুবিচার পাক। নাদির কিংবা তার ছাত্রী এই দুজনেরই যেন মেধা হত্যা না হয়। বাংলাদেশের জন্য মেধা রক্ষাই একমুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখক: মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, লেখক ও শিক্ষক।