শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়ম নিয়ে ভিকারুননিসায় আবারও বিশৃঙ্খলা

জানুয়ারি ১১, ২০২৪

‘বেপরোয়া’ গভর্নিং বডির কারণে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে আবারও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়মের তথ্য ফাঁস হওয়ার ঘটনায় এক শাখা প্রধানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সাময়িক বরখাস্ত করার পর বরখাস্ত আদেশ পরিবর্তন করে একই স্মারক ও তারিখে নতুন করে সাময়িক বরখাস্তের চিঠি দেওয়া হয়েছে মূল দিবা শাখা (বাংলা ভার্সন) প্রধান মো. শাহ আলম খানকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর (২০২৩) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে ২০২৪ সালে প্রায় ২৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ করেন দুই অভিভাবক। আর গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে একই অভিযোগ করেন গভর্নিং বডির সদস্য গোলাম বেনজীর। এই অভিযোগ ওঠার পর প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির বিষয়গুলো আলোচনায় আসে।

এই ঘটনার পর হঠাৎ করে গত ৪ জানুয়ারি ভিকারুননিসার মূল দিবা শাখা (বাংলা ভার্সন) প্রধান মো. শাহ আলম খানকে সাময়িক বরখাস্ত করে সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়।

অধ্যক্ষের সই করা প্রথম সাময়িক বরখাস্তের চিঠিতে উল্লেখ করা হয় ‘….গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের মৌখিক নির্দেশে’। এছাড়া চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘….প্রথম শ্রেণির ভর্তি সংক্রান্ত কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে মাউশি (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা) জারিকৃত ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির জন্য প্রযোজ্য নির্দেশনা অনুসরণ না করে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ভর্তির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে।’ অন্যদিকে সাময়িক বরখাস্ত করার একই স্মারকে জারি করা দ্বিতীয় চিঠিতে ‘কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী’ পরিবর্তন করে সুনির্দিষ্ট দুই জন ছাত্রীর নাম উল্লেখ করা হয়। এবং প্রথম চিঠিতে চেয়ারম্যানের মৌখিক নির্দেশে উল্লেখ থাকলেও দ্বিতীয় সাময়িক বরখাস্তের চিঠিতে তা রাখা হয়নি। এসব কারণে ভর্তি নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টরা।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ সুজন বলেন, “আসলে গভর্নিং বডি ‘বেপরোয়া’। ভর্তি বাণিজ্যে বাধা দেওয়ায় শাখা প্রধান শাহ আলম খানকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়েছে। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে নিজেদের দুর্নীতি ঢাকতে চান অধ্যক্ষসহ গভর্নিং বডি। ভর্তিতে দুর্নীতির অভিযোগে যদি শাহ আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করতেই হয় তাহলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ আরও দুই জন শিক্ষক প্রতিনিধিদেরও সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে।”

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, ভর্তি কমিটি ভর্তিতে সুপারিশ করেছে, অধ্যক্ষ সুপারিশ করে সই করেছেন। ভর্তি কমিটিতে রয়েছেন সিনিয়র শাখা (ধানমন্ডি প্রভাতী) প্রধান মাহমুদ আহমেদ, বসুন্ধরা (দিবা শাখা) ক্যাম্পাসের প্রধান জগদীস চন্দ্র পাল, ভিকারুননিসার মূল দিবা শাখা (বাংলা ভার্সন) প্রধান মো. শাহ আলম খান, গভর্নিং বডির সদস্য (স্কুল শাখা) আব্দুর রাজ্জাক আকন্দ ও গভর্নিং বডির সদস্য (সংরক্ষিত মহিলা) চাঁদ সুলতানা। এছাড়া ভর্তি মনিটরিং কমিটিতে ছিলেন গভর্নিং বডির সদস্য আনোয়ার কবির ভূইয়া পুলক এবং গভর্নিং বডির সদস্য মৌসুমী খান।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুপারিশে লিখেছেন ভর্তি কমিটির সুপারিশক্রমে ভর্তির জন্য নির্বাচিত করা হলো। এই কথা লেখার পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কীভাবে শাহ আলম খানকে সাময়িক বরখাস্ত করেন? আর ভর্তির আবেদনেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ভর্তির সুপারিশ করে ভর্তি করেছেন। এছাড়া পিতার জন্মসনদ ও পিতার জন্মসনদের নাম দিয়ে দুই জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে ভিকারুননিসায়। এ ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি গভর্নিং বডি ও অধ্যক্ষ। তাহলে শাহ আলমকে কেন সাময়িক বরখাস্ত করা হলো? স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে শাখা প্রধানের সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই সাময়িক বরখাস্তের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মো. শাহ আলম খান বলেন, ‘ভর্তি কমিটির সুপারিশের পর অধ্যক্ষ সুপারিশ করেছেন, তারপর শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। আমি একা ভর্তি করতে পারি না, ভর্তি করে অধ্যক্ষ। আমি শুধু সুপারিশ করতে পারি। তাছাড়া অনিয়মও হয়নি। কিন্তু কেন সাময়িক বরখাস্ত করা হলো তা বুঝতে পারছি না।’

জানতে চাইলে মূল দিবা শখা (বাংলা ভার্সন) প্রধান মো. শাহ আলম খানকে সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি স্বীকার করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া শাহ আলম ভর্তির জন্য একাই দায়ী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভর্তিতে সবাই জড়িত।’

তাহলে শুধু তাকেই কেন সাময়িক বরখাস্ত করা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এই ভর্তিতে সবাই জড়িত। নির্বাচন ছিল (জাতীয় নির্বাচন), স্যার (গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান) ব্যস্ত ছিলেন। এখন আমরা তদন্ত কমিটি করেছি, তদন্ত কমিটির আলোকে যা হবে তাই..। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার মানে এই নয় যে তিনি চলে যাবেন। তিনি যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে ফিরে আসবেন।’

শাহ আলমের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও আরও দুই শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। একজন শিক্ষার্থীর পিতার জন্মসনদ ও আরেকজন শিক্ষার্থীর পিতার জন্মসনদের নম্বর দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। এ অভিযোগ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, ‘সব কিছুই তদন্তের অপেক্ষায় রয়েছে। যদি সমস্যা থাকে তাহলে সে ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নেবো।’সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন