হাওরে পদ্ম

আগস্ট ২৩, ২০২৩

মাসকাওয়াথ আহসান: সগির আলীর একটাই স্বপ্ন, তার ছেলেটির জীবন তার মতো এমন কষ্টের হবে না। মাসের অর্ধেক যেতেই বেতনের টাকা ফুরিয়ে যায়। উপজেলা অফিসের কেরানি, সামান্য বেতন। হাওরের জেলেরা খুশি হয়ে মাঝে মাঝে মাছ নিয়ে আসে; কৃষকেরা লাউ-কুমড়া আনাজ; যার যা খুশি দিয়ে যায়; তাতে সংসারটা কোন মতে চলে যায়।
কিন্তু ছেলেটির বড় লোক হবার স্বপ্ন। বড় লোকের ছেলেদের কলেজে জিনস পরে আসতে দেখতে বায়না ধরে। জিনস প্যান্ট আর বেইলি কেডস না পরলে কেউ ছাত্রদলের মিছিলে নিতে চায়না। সগির আলী সুনামগঞ্জ বাজারে গিয়ে ধার কর্জ করে ছাত্রদলের জার্সি কিনে দেয়।
ছেলে জানায়, তার নামটি আধুনিক নয়। মোকসেদ আলী নামটি বড্ড ক্ষ্যাত। বাপ ধমক দেয়, ক্ষেতের মূলাডা-আলুডা খেয়ে বাঁচিস আবার নাক উঁচা ভাব দেখাস। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা ভালো নারে মোকসেদ।
কলেজে বড় লোকের ছেলে দেখলে কিংবা ভালো ছাত্র দেখলে মোকসেদ ভেতররা রাগে রি রি করতে থাকে। ছাত্রদলের গরম দেখিয়ে একে ওকে ধমক দেয়, ভারত চইলা যা।
ছাত্রদল করে রেজাল্ট খারাপ হলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। তখন শাহজালালের মাজারে মা মানত দিলে কোনমতে শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যবস্থা হয়।
এইসময় ছাত্রদলের আরেকবন্ধুর দুই একটা লেখা ভোরের কাগজের পাঠক ফোরামে প্রকাশ হতে দেখে, সেখানে লেখা পাঠায় মোকসেদ। এইবার তাকে লেখক হতে হবে। কিন্তু একটি লেখা তার হলোনা কোথাও ছাপা; পেলোনা সে প্রতিভার দামটা।
দূর সম্পর্কের এক মামা চেষ্টা তদবির করে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয় মোকসেদকে। আশা ছিলো একটু পড়ালেখা করে যদি ওখানেই থেকে যেতে পারে।
কিন্তু ঐ যে লেখক হবার ঘোড়ারোগ। এরমধ্যে ব্লগ জিনিসটা এসে পড়লে মোকসেদ চোখ বুঁজলেই স্বপ্ন দেখে, ব্লগে লিখে সে ফাটিয়ে ফেলার পর, ঢাকায় একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছে!
এইভাবে প্রতিরাতে অটোগ্রাফ দিতে দিতে পড়ালেখা শিকেয় ওঠে। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সুতরাং ব্লগ লীগের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মোকসেদ। তার লেখার বাক্যগুলো ঠিক মতো হয়না। লেখায় গতি আসে না। তখন তাকে ঠিকুজিদাদা হালদা রায় শেখায়, শোনেন দাদা, আমরা যারা অসহনীয় শৈশবে বেড়ে উঠেছি, তাদেরকে প্রতিহিংসা পরায়ণ হতে হয়। এক কাজ করেন, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের নিয়ে কাসুন্দি করেন, তাদের বেডরুমের খবর রগরগে করে প্রকাশ করুন। নাম ফেটে যাবে। মোকসেদ তখন ব্লগে ও ফেসবুকে “দৈনিক কইয়া দিমু”-র সম্পাদক হয়।
লন্ডনে যেহেতু কোন হিল্লে হলো না; সুতরাং এবার দেশপ্রেমের ধান্দা করতে হবে দেশে ফিরে। পতাকাওয়ালা টি শার্ট পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চলমান পোস্টারবয় হয়ে উঠতে হবে।
এসময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কপি পেস্ট করে কিছু একটা বই বানাতে পারলেই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিনে নেয়। ফলে মোকসেদ হয়ে পড়ে ইতিহাসান মোকসেদ।
মুক্তিযুদ্ধ শব্দটা দেখেই আকৃষ্ট হয় শিক্ষিত প্রগতিশীল সমাজের গুটিকতক। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সমাজে ইতিহাসান মোকসেদ অল্প একটু হার্ট থ্রবের ফিল পায়। একটু আওয়ামী লীগের আমেজ পেয়েই, এবার মোকসেদ সম্পন্ন পরিবারের সুখি মানুষদের আর সফল লেখকদের পাকিস্তান চইলা যা বলতে থাকে।
সগির আলীর ছোট্ট টিনশেডের বাড়ি, কেরানির টেনেকষে চলা জীবন, মোকসেদের মধ্যে শৈশবে আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি হবার কারণেই সে ছাত্রদল করে আত্মপরিচয় তৈরি করতে চেয়েছিলো। আওয়ামী লীগ করে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আত্মপরিচয়হীনের স্বপ্রণোদিত হয়ে দেশের মালিকানা দাবীর ইতিহাস পুরোনো। ১৯৪৭ সালের পরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কহীন ছিন্নমূল লোকেরা দেশের মালিক সেজে প্রতিষ্ঠিত লোকেদের “ভারত” চলে যাবার নির্দেশ দিতে থাকে। ১৯৭১ সালের পর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কহীন ছিন্নমূল লোকেরা দেশের মালিক সেজে প্রতিষ্ঠিত লোকেদের “পাকিস্তান” চলে যাবার নির্দেশ দিতে থাকে।
মোকসেদ ঢাকা শহরে এসে তবু তাল তুলতে পারেনা। উচ্চারণে আঞ্চলিকতার অসংখ্য হিজিবিজি টান থাকায় টিভি টকশোতেও পাকাপোক্ত কোন জায়গা মেলে না।
তখন চোখে প্রয়োজন না থাকলেও চশমা লাগিয়ে; ফতুয়া পরে ট্রেন্ডি হয়ে ঘুরে ফিরে ঐ সুনামগঞ্জেরই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সেজে ঘোরা ছাড়া উপায় থাকেনা। জেলা পরিষদের মুজিব শতবর্ষ উদযাপন কমিটি, এটা কমিটি ওটা কমিটিতে ঢুকে; নামে মাত্র লোকদেখানো অনুষ্ঠান করে টেকাটুকাগুলো ভাগ করে নেয়; থাগস অফ বেঙ্গলেরা।
কিছু কাঁচা পয়সার মুখ দেখে ইংরেজি বই পড়ার ভঙ্গিতে কফি খাইতেছি বলে ফেসবুক পোস্ট দিয়ে আরবান কলতলার শেফালি-চামেলি-জুলেখার বুকে তোলপাড় তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরের সন্দ্বীপের একটি লোকজ সংস্করণ হিসেবে, ফেসবুকের ইনবক্সের ঘরে বাইরে পেলব করে প্রেম ও দেশপ্রেমের কথা বলতে বলতে হিরো হীরালালের মতো লাল শার্ট জিনস চশমা পরে; ঢালিউডের নায়কের বেশে ভেসে ওঠে ইতিহাসান মোকসেদ।
ঢাকায় টি গার্ডেনের মালিক চৌধুরী বাড়িতে দাওয়াত পেলে সেখানে ইংলিশ ভিংলিশ এলিট ছেলেমেয়েদের মাঝে হিরো হীরালালকে ফিশ আউট অফ ওয়াটার মনে হয়। ব্যালকনিতে গিয়ে সিগেরেট ধরিয়ে মোকসেদ সলিলকি করে, নাদের আলী আমি আর কত বড় হবো!
ট্রেনে করে ফেরার সময় কানের কাছে সগির আলী এসে বিলাপ করে বলে, আগেই বলছিলামরে মোকসেদ, ছেঁড়া খেতায় শুয়ে চৌধুরী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে নাই।

লেখক: সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া ।