মনসুরের মায়ের দাওয়াত

আগস্ট ১, ২০২৩

মাসকাওয়াথ আহসান:    মধুমতী নদীর ধারে মনসুরের মায়ের সাজানো সংসার; বেলা গেলো হাঁস-মুরগী ঘরে তোলোর আটচালা টিনের ঘর। চাতালে পেয়াজ-রসুন। গোলায় ধান; তার পাশে ঢেঁকি। তার পাশে উনুনে ফুঁকনি দিয়ে মুরগার সালুন রাঁধতে রাঁধতে মনসুরের মা ফিরিস্তি দেয়; সে কাকে কাকে কবে দাওয়াত খাইয়েছে।
মশলা বাটতে বাটতে সফেদার মা জিজ্ঞেস করে, ও খালা হেইবার যে ঐ মওলানা সাহেব দাওয়াত খাইয়া গেলো; দাওয়াত খাওয়ার পর ব্যাডার কী জানি হইছিলো!
-আর কইস না; হেই ব্যাডা মওলানা মসজিদে আলাপ তুলছিলো, মনসুরের বাপে নাকি ইউনিয়ন বোর্ডে আসা ব্যাবাক রিলিফ খাইয়া দিছে!
-খালু কী খাইছিলেন হেইডা!
মনসুরের মা মুচকি হেসে বলে, কিছু খাইতে হয় কিছু বিলাইতে হয়; এইডা পুলিটিকসের টেডিশন।
–তারপর কী হইলো খালা!
–কী আর হইবো বাদ জুম্মা মওলানারে দাওয়াত দিলাম; মুরগার সালুন খাওয়াইলাম; হের পরে পুরা গ্রামে ঢোল পিটাইয়া দিলাম, আমগোর বাড়িতে মওলানা সাহেব কী কী খাইছে! কইছি, মওলানা যে বইলা বেড়ায় আমরা রিলিফের গম চুরি কইরা খাইছি; তো এই মিহিন আটার রুটি তো তার প্যাটেও গেছে।
এরপর থেকে গ্রামের লোক মনসুরের মায়ের দাওয়াতকে ভয় পায়। কেউ দাওয়াতে আসতে রাজি নাহলে সফেদার মাকে পাঠায়, শাড়িটা উঁচু করে গোপালী কায়দায় দুটি ঝগড়া তুলে গালি দিয়ে আসতে। সুতরাং মনসুরের মায়ের দাওয়াত খাইলেও বিপদ; না খাইলেও বিপদ।
গ্রামে ঢাকা থেকে এক নেতা এলে মনসুরের মা দাওয়াত করে খাওয়ায়। যাওয়ার সময় বলে, আপনেরে যে এতো কিছু খাওয়াইলাম; এখন মনসুররে আপনার লগে নিয়া যান। ও নিজে গাছে উইঠা ডাব পাইড়া আনছে আপনের জন্যে। বেকার পোলাডারে একটা কাম কাইজ দেন। দরকার হয় তামুক সাইজা দিবো। মনসুর পারেনা এমন কাম নাই। পুলিটিশে অর বেরেন আছে; অর প্যাঁচের ঠেলায় মধুমতী নদী পাড়ের লোকেরা অস্থির। অরে নিয়া যান।
মনসুর ঢাকা এসে নেতার হাতা হয়ে তার মায়ের দাওয়াত দিয়া গান্ধা কইরা দেওয়ার পলিটিকস চালু করে। খাওয়ার খোঁটা দেয়ার রাজনীতিতে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হয় তার। কারণ বাঙালি সমাজ আতিথেয়তার সমাজ; দাওয়াত দেয়া ও দাওয়াত গ্রহণ করা দুটোই শিষ্টাচারের অংশ। ফলে সমাজের সরল ভদ্র মানুষেরা মনসুরের দাওয়াত ও খাওয়ার খোঁটার পলিটিকসের কাছে ধরাশায়ী হয়ে যায়।
দলের প্রধান নেতার গুনাবলীকে ছাপিয়ে মনসুরের মধুমতী নদী পাড়ের ভিলেজ পলিটিক্স পার্টি কর্মীদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। “দাওয়াত দেও-তারপরে খাওয়ার ছবি তুইলা খোঁটা দেও-তারপর গান্ধা কইরা দেও”- মনসুর শাস্ত্র এইভাবে চাণক্যকেও পিছে ফেলে দেয়।
মনসুর পার্টিতে বস্তির ছোট খাটো হোটেল মালিকদের রিক্রুট করে; যাতে তারা দাওয়াত করে পাতে খাবার তুলে দেবার কাজটা করতে পারে দক্ষতার সঙ্গে।
মনসুর নেই; কিন্তু তার মায়ের দাওয়াত ডকট্রিন ও খাওয়ার খোঁটা দেবার গোপালী কালচারটা রাজত্ব করে শহুরে সংস্কৃতিতে। নেতাকে লিকিং করে পাতি নেতা হওয়া লোকেরা; কিংবা পার্টির গ্যাটিসে সরকারী চাকরিতে ঢুকে পড়া দাওয়াতিরা; প্রতিপক্ষের লোকদের দাওয়াত ও খাওয়ার খোঁটার মাধ্যমে রাজনীতিতে দফার রফা ফিশরোল বানাতে থাকে।
এই সংস্কৃতির লোকেরা ফেসবুক আসার পর লোককে দাওয়াত দিয়ে ভিডিও করে ছেড়ে দিয়ে খাওয়ার খোঁটার অডিও-ভিজুয়াল আঙ্গিক তৈরি করে। খাওয়ার খোঁটা প্রবেশ করে মনসুরের এনালগ সাদাকালো ছবির খোঁটা থেকে; অরুণ-বরুণ-কিরণমালার ভিডিও-র খোঁটায়।
মনসুরের মা রুলস ওভার দ্য পলিটিক্যাল ওয়ার্ল্ড; উইদাউট দ্য ফিয়ার অফ ডেথ। চাঁদের বুড়ির মাথায় তেল বসিয়ে দিতে দিতে সে বলে, দাওয়াত কইরা যা খাওয়াইবা; ঐ খোঁটাডা ছুইড়া মারবা; ব্যাস দেখবা মনসুরের মতো ইতিহাসে নাম লেখাইয়া ফেলছো মহৎ নেতা হিসাবে।

লেখক:  সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া