না প্রধান শিক্ষক না অধ্যক্ষ, শ্রেণিকক্ষ দখল করে থাকেন পরিবার নিয়ে

জুন ২৪, ২০২৩

ছিলেন উত্তরার নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি কলেজে উন্নীত হলে অধ্যক্ষ পদে অবৈধভাবে নিয়োগ নেন মো. শাহিনুর মিয়া। নিয়োগের পর শুরু করেন অর্থ আত্মসাৎ। কলেজের দুটি শ্রেণিকক্ষ আবাসিকের আদলে গড়ে তুলে পরিবার নিয়ে থাকা শুরু করেন। এসবের প্রতিবাদ জানালে ১৮ বছর ধরে এমপিও (বেতন বাবদ মাসিক সরকারি অনুদান) না করিয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষককে জিম্মি করেন। শুধু তাই নয়, একজন সিনিয়র শিক্ষকের বেতন বন্ধ করে রাখেন ২২ মাস।

সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনের পর অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ মো. শাহিনুর মিয়াকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। গত বৃহস্পতিবার (২২ জুন) সহকারী পরিচালক তপন কুমার দাস স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানো নোটিশটি ইস্যু করা হয়।

সহকারী পরিচালক তপন কুমার দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি হলে মহাপরিচালক ছাড় দেবেন না, সে কারণে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। অধ্যক্ষের দুর্নীতির কারণে কারণ দর্শানোর নোটিশ করেছি। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব চাওয়া হয়েছে। জবাব সন্তোষজনক না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে মো. শাহিনুর মিয়া  বলেন, ‘পার্শিয়ালিটি করে তদন্ত করে ফেলেছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়নি।’

ক্লাসরুম দখল করে বাসাবাড়ি করে থাকেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কলেজের গভর্নিং বডি রেজুলেশন করে বিষয়টি পাস করে দিলে এটি বৈধ না অবৈধ হলো? গভর্নিং বডি চাকরি দেওয়ার মালিক, চাকরি খাওয়ার মালিক। এ জন্যই বলছি, অফিসে আসেন।’

তদন্ত প্রতিবেদনের অভিযোগের প্রমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কথা বাড়ি খাচ্ছে। অফিসে বসে সুন্দর করে কথা বলা যাবে।’

না প্রধান শিক্ষক না অধ্যক্ষ

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে স্কুল থেকে কলেজে উন্নীত হওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মো. শাহিনুর মিয়া। কলেজে উন্নীত হলে একই সঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেতে ২০১১ সালের ৫ আগস্ট গভর্নিং বডির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক মো. শাহিনুর মিয়া পদত্যাগ করেন। এরপর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয় শাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়াকে।

২০১১ সালের ১৯ আগস্ট অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নিয়োগ পরীক্ষার পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শাখাওয়াত হোসেন ভুঁইয়া ওই বছরের ২৭ আগস্ট রেজুলেশনের মন্তব্যে লেখেন— বিধি মোতাবেক না হওয়ায় অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হলো না। কিন্তু ২০১১ সালের ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত গভর্নিং বডির সভায় অধ্যক্ষ পদে মো. শাহিনুর মিয়াকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এতে স্পষ্ট হয়, ২০১১ সালের ১৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে মো. শাহিনুর মিয়া অধ্যক্ষ হতে পারেননি এবং পদত্যাগ করার কারণে তিনি আর ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ কোনোটিই নন।

‘কিন্তু গভর্নিং বডিকে বোকা বানিয়ে ২০১১ সালের ২৮ আগস্ট শাহিনুর মিয়া অধ্যক্ষ পদের নিয়োগপত্র নেন এবং ১ সেপ্টেম্বর তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। এটা কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে শাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।’

তদন্ত প্রতিবেদনের মন্তব্যে বলা হয়, মো. শাহিনুর মিয়া যেমন প্রধান শিক্ষক নন, তেমন অধ্যক্ষও নন। ওই প্রতিষ্ঠানে তার অবস্থান সম্পূর্ণ অবৈধ।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শক্তভাবে প্রমাণিত যে স্কুলটি কলেজে উন্নীতকরণের সময়ে মো. শাহিনুর মিয়া প্রধান শিক্ষক ছিলেন এবং প্রধান হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকায় অধ্যক্ষ হিসেবে তার নিয়োগ সরকারি বিধিমালা অনুসারে বৈধ নয়।

মো. শাহিনুর মিয়া প্রধান শিক্ষক পদ থেকে পদত্যাগ এবং অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ সম্পর্কে তদন্ত কমিটির সঙ্গে মিথ্যাচার এবং অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তিনি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন।

 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের উত্তর পাশের ‘গ্রুপ ক্যাপ্টেন আইয়ুব আলী পিএসসি ভবন’-এর ৫ম তলায় দুটি শ্রেণিকক্ষের আকার কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে পরিবর্তন করেন অবৈধ অধ্যক্ষ। তিনি নিজের জন্য আবাসিক কোয়ার্টার তৈরি করে ২০১০ সাল থেকে অধ্যক্ষ ও তার পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন। এছাড়া তিনি বাসায় তিনটি এসি ব্যবহার করেন প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের লাইন থেকেই। প্রতিষ্ঠানের তিন-চার জন অফিস সহায়ক/আয়াকে তিনি নিজের বাসার কাজ করতে বাধ্য করেন।

অর্থ আত্মসাৎ

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের উত্তর দিকের রাস্তা বরাবর অংশে ১৭টি দোকান, ৭টি এটিএম বুথ, ৩টি ব্যাংক ও ২টি অফিস হতে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অধিকাংশ অর্থই আত্মসাৎ করেছেন মো. শাহিনুর মিয়া। এছাড়া গুঞ্জন রয়েছে, দোকান ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অগ্রিম অর্থ যা প্রায় কোটি টাকারও বেশি, তিনি নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন।

মো. শাহিনুর মিয়া সরকারি অংশের বেতন ভাতাদি ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে নগর ভাতা ও অন্যান্য ভাতা মিলিয়ে ৭০ হাজার টাকা, শিফটিং ভাতা ৫০ হাজার টাকা ও কারিগরি ভাতা বাবদ ২০ হাজার টাকাসহ মোট এক লাখ ৪০ হাজার টাকা অবৈধভাবে প্রতি মাসে উত্তোলন করেন।

আড়াই বছর ধরে অ্যাডহক কমিটি

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আড়াই বছর ধরে প্রতিষ্ঠানে অ্যাডহক কমিটি দিয়ে চালাচ্ছেন অবৈধ অধ্যক্ষ। ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড গভর্নিং বডি গঠন ও নির্বাচন সংক্রান্ত পত্র দেয়। কিন্তু তিনি গভর্নিং বডি গঠন না করে আরও দুইবার অ্যাডহক কমিটি গঠন করেছেন। নামমাত্র এই অ্যাডহক কমিটি তার দুর্নীতির প্রধান হাতিয়ার। তার আস্থাভাজন সহকারী শিক্ষক আরেফা বিল্লাহ ওই কমিটির একজন স্থায়ী সদস্য। অভিযুক্ত মো. শাহিনুর মিয়ার গভর্নিং বডির নির্বাচন না দেওয়া ইচ্ছাকৃত।

১৮ বছর ধরে এমপিও না করিয়ে শিক্ষকদের জিম্মি

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৮ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এমপিও না করিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। সবাইকে নিজের অনুগত করে রাখার কৌশল হিসেবে তিনি এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। অধ্যক্ষের এই স্বেচ্ছাচারিতার কারণে অনেক শিক্ষক প্রাপ্যতা থাকা সত্ত্বেও এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। তিনি তাদের বঞ্চিত করেছেন।

সিনিয়র শিক্ষকের বেতন বন্ধ ২২ মাস

প্রতিষ্ঠানের নন-এমপিও শিক্ষকদের তালিকায় জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মাহমুদা খাতুন। কিন্তু অধ্যক্ষ তাকে বাদ দিয়ে তার আস্থাভাজন সহকারী শিক্ষক আরেফা বিল্লাহর এমপিওভুক্তির ফাইল গোপনে ঊর্ধ্বতন অফিসে পাঠান। বিষয়টি জানতে পেরে মাহমুদা খাতুন থানা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার ও আঞ্চলিক উপ-পরিচালককে তার জ্যেষ্ঠতার প্রমাণ দেখান। এরপর কর্তৃপক্ষ আরেফা বিল্লাহর এমপিওভুক্তির ফাইলটি বাতিল করেন। এতে অধ্যক্ষ রেগে গিয়ে মাহমুদা খাতুনের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন শুরু করেন। মাহমুদা খাতুনের প্রতিষ্ঠানের বেতনও বন্ধ করে দেন অধ্যক্ষ। প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহমুদা খাতুন দীর্ঘ ২২ মাস বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

কলেজ শাখার স্বীকৃতির নামে অর্থ আত্মসাৎ

অবৈধ অধ্যক্ষ শাহিনুর মিয়া প্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখার স্বীকৃতি নেওয়ার নামে শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছেন। মো. হারুনুর রশিদ প্রতিষ্ঠানের দুই প্রভাষক মো. উসমান গনি ও মো. সাজ্জাদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষকরা তিন লাখ টাকা অধ্যক্ষকে দিয়েছেন- সার্বিক পরিস্থিতি ও সাক্ষীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে অভিযোগটি সত্য বলে প্রতীয়মান।

তদন্ত প্রতিবেদনে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, অধ্যক্ষের অনুগত সহকারী শিক্ষক আরেফা বিল্লাহর আত্মীয়-স্বজনের চাকরি দেওয়ার জন্যও প্রায় কোটি টাকা নিয়োগ বাণিজ্যের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণসহ সুনির্দিষ্ট কয়েকটি অভিযোগের প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।