ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনতে চায় ডিএমপি

জুন ১৯, ২০২৩

রাজধানী ঢাকা একাধারে দেশের সবচেয়ে জনবহুল ও ব্যস্ততম নগরী। এই শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অন্য অনেক জায়গার চেয়েই বেশি জটিল। যানজট ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনায় নাকাল ঢাকার রাজপথ। এই অবস্থায় বড় পরিবর্তন আনতে চায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তারা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরও সুন্দর করতে তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। সেফটি এডুকেশন, ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট রিপোর্ট অ্যানালাইসিস ও ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ কাজে তাদের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পের মেয়াদ এরইমধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে। প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে রমনা বিভাগে চলে আসছিল এর কার্যক্রম। তবে এখন ডিএমপির ৮টি ট্রাফিক বিভাগ সমন্বিতভাবে নিজ নিজ এলাকায় এই প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করছে। ডিএমপি-জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সমন্বয়ে ‘ঢাকা রোড ট্রাফিক সেফটি প্রজেক্ট (ডিআরএসপি)’ এর আওতায় এ কার্যক্রম চলছে।

ডিআরএসপি হলো তিন বছরের জন্য একটি প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রকল্প। এর লক্ষ্য ঢাকা মহানগরীতে ট্রাফিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ডিএমপির সক্ষমতা জোরদার করা। ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়েছে যানজট নিরসনের এ প্রকল্প। এরই মধ্যে বেশ কয়েক দফা যৌথ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

পুরো প্রকল্পের ব্যয় বহন করছে জাইকা। বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে যেখানে যে ধরনের অর্থ ব্যয় হয়, তা সরাসরি জাইকা পরিশোধ করছে। সম্প্রতি জাপানের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং সে দেশের ট্রাফিক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য ট্রাফিক পুলিশের ১৫ সদস্য জাপান ভ্রমণ করেছেন। এই প্রকল্পে জাইকার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নের বিষয়টি পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে।

 

জাইকার এই প্রকল্পটি রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে দাবি করছেন ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ডিএমপির বর্তমান যে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেটা আরও আধুনিকায়ন হবে। জনসাধারণের চলাচল, সঠিকভাবে গণপরিবহন পরিচালনা, মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জ্ঞানবৃদ্ধিসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে এই প্রকল্পের আওতায় ডিএমপি কাজ করছে।

 

প্রকল্পের আওতায় তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। প্রথমটি হলো সেফটি এডুকেশন। যেখানে স্কুল লেভেল থেকে শুরু করে সেকেন্ডারি লেভেল এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রাইমারি লেভেল থেকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো ছোট বাচ্চাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারলে ভবিষ্যতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সঠিক জ্ঞান ও আইন মানার প্রবণতা তাদের মধ্যে বাড়বে। ট্রাফিক আইন মেনে চললে দুর্ঘটনা কমে যায়, হতাহতের ঘটনাও কমবে— এসব বিষয়েও আলোচনা করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় ধাপে ট্রাফিক এক্সিডেন্ট রিপোর্ট অ্যানালাইসিসের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানগত কোনও তারতম্য যেন না হয়, সে ব্যাপারে কাজ চলছে। পুলিশের অপরাধ বিভাগ, থানাগুলোর সঙ্গে ট্রাফিক বিভাগের তথ্যের গড়মিল যেন না হয়, এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ সংক্রান্ত সফটওয়্যার এমনভাবে ডেভেলপ করা হচ্ছে— যেখানে থানা পুলিশ এবং ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা প্রবেশাধিকার পাবেন। এতে করে কোথাও কোনও ঘটনা ঘটলে, তখন আর থানা পুলিশের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের তথ্যের গরমিল হবে না। তা না-হলে পরিসংখ্যানগত কোনও তথ্য উপস্থাপন করা হলে— তথ্যের গড়মিলের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।

তৃতীয় ধাপে ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট বাস্তবায়নের লক্ষ্য বলতে বোঝানো হয়েছে— সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি চলাচলে সবার সচেতনতার বিষয়টি। যেখানে ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে, সেগুলো ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যদি ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে হাতের ইশারায় সড়ক পারাপারের চেষ্টা করা হয়, তাহলে কী ধরনের আইন প্রয়োগ করা হবে— এসব বিষয় পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এছাড়া জেব্রা ক্রসিং, বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যাল ও রোড সাইন— যেগুলো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অবিচ্ছেদে অংশ, সেসব বিষয়ে বোঝানো হচ্ছে।

ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ সূত্র বলছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাধীন এলাকায় দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করার কাজ চলছে। কোন এলাকায় দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে, কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে, তার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় দ্রুতগামী যানবাহন যেমন চলাচল করছে, তেমনই একই রাস্তায় চলছে ধীরগতির বাহন রিকশাও। এছাড়া গণপরিবহনে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, এমনকি যাত্রীর ইশারায় পেছনে লক্ষ্য না করেই যখন-তখন সড়কের মাঝখানে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দেওয়া বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু যাত্রী কিংবা পথচারীদের সচেতন নয়, পরিবহন-সংশ্লিষ্ট চালক ও হেলপার, গাড়ির মালিকদেরও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা মেনে গাড়ি চালানোর পরামর্শ দিচ্ছে ডিএমপি।

 

রাজধানীতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বিষয় উল্লেখ করে ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা  বলেন, যখনই কেউ আইন ভাঙেন, তখন তার নিজের এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা আসে না। তিনি নিজের ক্ষমতা জাহির করতে পরিচিত সরকারি কর্মকর্তা, কিংবা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার শরণাপন্ন হন। যা মাঠে থাকা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মাঠে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে এসব বিষয়ে অনেকটা আতঙ্ক বিরাজ করে। তারপরও ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা, সেই সঙ্গে যানজট কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন।

তিনি আরও জানান, একইসঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা রেজিস্ট্রেশন বিহীন গাড়ি পেলেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যদিও সেসব গাড়ি ডাম্পিং করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, রাজধানীতে অবস্থিত ডাম্পিংয়ের জায়গগুলো এমনিতেই ভরপুর। মামলা দেওয়ার পরও সেসব গাড়ি রীতিমতো রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যা প্রায়ই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ চ্যালেঞ্জিং একটি জায়গা উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান  বলেন, ‘প্রতিনিয়ত যারা সড়ক ব্যবহার করছেন— পথচারী, যাত্রী, বিভিন্ন পরিবহনের আরোহী, চালক, হেলপার সবাই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার স্টেক হোল্ডার। সবার মধ্যেই ট্রাফিক সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম জ্ঞানের বিষয়টি তুলে ধরার জন্য নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে সেফটি এডুকেশনের মাধ্যমে। ছোটবেলা থেকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও আইনের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে ঢুকিয়ে দিতে পারলে, এ বিষয়ে তারা সচেতন হতে পারবে। ন্যূনতম সচেতনতা যেন সবার মাছে তৈরি হয়, এজন্য স্কুল পর্যায় থেকে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা সড়কে চলাচল করবেন, তাদের যদি ট্রাফিক রুলসের মূল বিষয়গুলো জানা থাকে, তাহলে নিজের তাগিদেই নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি সচেতন থাকবেন। সড়কে ট্রাফিকের দুই ধরনের কাজ রয়েছে। একটি হচ্ছে ফেটাল এক্সিডেন্টের ঘটনা। সেগুলো নিয়ে থানায় মামলা হয়। সেটা পেনাল প্রফেশনের আওতায় চলে যায়। আর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর আওতায় কিছু কিছু মামলা, যেগুলো শুধুমাত্র ট্রাফিক বিভাগ করে থাকে। পুলিশের ক্রাইম বিভাগ এক ধরনের কেস নিয়ে ডিল করে, আর ট্রাফিক বিভাগ আরেক ধরনের কেস নিয়ে ডিল করে। যখন সেপারেট ঘটনা নিয়ে কাজ করে, তখন তথ্যের গড়মিল দেখা যায়। সেজন্য আমাদের সফটওয়্যারগুলো এমনভাবে তৈরির চেষ্টা করছি, এমন কিছু লিংক দেওয়ার চেষ্টা করছি, যাতে তথ্যের কোনও গরমিল না হয়। তথ্য যেন সবার কাছে একই থাকে। আমরা চাই, যেসব তথ্য থানা পুলিশের কাছে আসে, সেসব তথ্য ট্রাফিক পুলিশের কাছেও আসবে এবং ডাটাগুলো একই জায়গায় থাকবে। এতে করে তথ্যগত বিভ্রান্তি দূর হবে।’