আন্তঃনগর ট্রেন এবং সালেহার গল্প

জানুয়ারি ১৪, ২০১৩

এস এম আববাস: চল্লিশোর্ধ সালেহা বয়সের ভারে নয়, সংসারের ভারে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তার আর ভালো লাগে না জিআরপি, রেলওয়ে এটেনডেন্টদের সাথে দর কষাকষি করতে। সাতদিন অসুস্থ থাকার পর গত ১৫ জুলাই মঙ্গলবার সকাল সোয়া ৭টায় রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর সিল্কসিটি ট্রেনে শুরু হয় তার প্রতিদিনের জীবন।

আন্তঃনগর সিল্কসিটি ট্রেনের চ বগির ১ নম্বর সিটের ওপর বাঙ্কারে রাখা একটি ব্যাগ তল্লাশি করছেন রেলওয়ে পুলিশের এক কনস্টেবল। এর কিছুক্ষণ আগে আব্দুলপুর স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানো অবস্থায় সালেহার সাথে কথা হয় ওই পুলিশ কনস্টেবলসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের। সালেহা অন্য একটি সিট থেকে দৌঁড়ে গিয়ে পুলিশকে বললো, মামা আপনাকে বললাম আমার ব্যাগটা এই জায়গায় আছে। এটিই আমার ব্যাগ। সালেহা তার ব্যাগ দেখিয়ে আবার ফিরে আসলো, সেই সাথে পুলিশটিও তার ডিউটি করতে থাকলো। সিটে ফিরে গিয়ে সালেহা দেখতে পেলেন, তা দখল হয়ে গেছে। উপায়হীন হয়ে নিজ ব্যাগের কাছে ১ নম্বর সিটের পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে পড়লেন তিনি। সেদিনও তিনি টিকিট কাটতে পারেননি। তবে টিকিট না কাটলেও কোন অসুবিধে হয় না তার। এক নম্বর সিটে তাকে বসতে বলা হলেও তিনি বসলেন না।

কিছুক্ষণ পর একজন এটেনডেন্ট তাকে জিঙ্গাসা করে, মাল কয়টা আছে? সালেহা বলে আটটা। কিন্তু আটটার টাকা দিতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত তাকে ৫০ টাকা দিয়ে রেহায় হলো। এ ঘটনার পর সালেহার কাছে জানতে চাওয়া হলো-তার ব্যাগে কি আছে? সে অনায়াসে বলে ফেললো ভারতীয় শাড়ি। এক পর্যায়ে তার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি তার বিগত ১৮ বছরের ভারতীয় শাড়ি বিক্রির কষ্টের কথা এবং সংসারের দুর্দশার কাহিনী বলতে থাকেন।

১৮ বছর আগে সালেহার স্বামী রাজমিস্ত্রির জোগানদার মারা যান। রেখে যান স্ত্রী এবং চারটি সন্তান। সালেহার সংসারে নেমে আসে দুর্দশা। সেই থেকে সালেহা ভারতীয় শাড়ি বিক্রি করে সংসার চালান। এ ব্যবসা করে বিয়ে দেন বড় মেয়ে খুশি ও হাসির। বিয়ের পরও দুই মেয়ের সংসারে সচ্ছলতার জন্য তাকে কম ঘানি টানতে হয়নি। এখন ছোট মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে। ছেলে হাসান ট্রাকের হেলপারি করে। ছোট ছেলে সপ্তাহে দু-তিনশ টাকা দেয় সংসার চালাতে কিন্তু তাতে কিছুই হয় না। তাই পুরানো শাড়ি ব্যবসা বন্ধ করতে পারেননি তিনি।

শাড়ি ব্যবসার জন্য সালেহাকে সপ্তাহে দু-তিনদিন পাড়ি দিতে হয় উল্লাপাড়ায়। রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সকাল সোয়া ৭টার সিল্ক সিটিতে ১৬৫ টাকায় টিকিট কেটে শাড়ির ব্যাগ নিয়ে রওনা হন। ব্যাগে থাকে বিভিন্ন দামের ৮ থেকে ১০টি জর্জেট শাড়ি। এ শাড়িগুলো ভারতীয় হলেও বাংলাদেশে জরি, চুমকি বসিয়ে বিক্রি করা হয়। শাড়িগুলোর চাহিদা রয়েছে ঢাকার নিউমার্কেট, গাওছিয়া, বঙ্গবাজার, গুলিস্তান এবং পাবনার উল্লাপাড়ায়। বিক্রি হয় এক হাজার টাকায়। তবে ভাল-মন্দের জন্য কিছু কম-বেশিও হয়।

সালেহা জানান, এ ব্যবসা তার আর ভালো লাগে না। স্টেশনে ঢুকেই জিআরপিকে একশ টাকা দিয়ে শুরু করতে হয়। আরও চারদফা টাকা দিয়ে তবে উল্লাপাড়ায় পৌঁছাতে হয়। তবে ঢাকায় গেলে আরও দু-দফা বেশি লাগে। সকালে স্টেশনে একশ টাকা দিয়ে ট্রেনে উঠেই ডিউটিরত জিআরপিকে দিতে হয় পঞ্চাশ টাকা। টিকিট না থাকলেও অসুবিধা নেই। পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিলেই ব্যবস্থা হয়ে যায়। এরপর যে বগিতে মালামাল নিয়ে উঠা সে বগির এটেনডেন্টকে দিতে হয় ২০ থেকে ৭০ টাকা, মাঝেমধ্যে ১০০ টাকা। ঈশ্বরদীতে ট্রেনের লোক বদল হলে আরও একবার দিতে হয় ৫০ টাকা। রেলওয়ের শত শত যাত্রীর সামনেই ঘটে এ টাকা লেনদেনের ঘটনা। সালেহা জানায়, তার মতো আরও ১০ থেকে ১৫ জন এ কাজের সাথে জড়িত। তবে সবাই একইদিনে আসে না।

এতো গেলো সালেহার গল্প; কিন্তু উন্নতমানের আন্তঃনগর এই ট্রেনে আরও যে কত প্রকার অনিয়ম চলে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। যাত্রীরা টিকিট কেটেও আসন পান না। অথচ পুলিশ বসে থাকে এক সিটে আর বন্দুক থাকে আর এক সিটে।

গত বৃহস্পতিবার রাত পৌঁনে ১২টার পদ্মা ট্রেনে সরজমিনে দেখা যায়, পুলিশ তাদের দখলে রাখা সিট ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে। মূলতঃ যারা টিকিট কেটে না উঠেন তারাই কমদামের এসব সিট সংগ্রহ করেন। আর যারা টিকিট কেটেও সিট পান না তারাও পুলিশের হয়রানির ভয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে যান। তবে আসনবিহীন ট্রেনের যাত্রীর সংখ্যা বেশি থাকায় টিকিট না থাকা যাত্রীরা খানিকটা সুযোগ পেয়ে যান।

অন্যদিকে, টিকিট না কাটা যাত্রীদের কাছ থেকে টিকিটের সমপরিমাণ টাকা কিংবা কম টাকা পকেটে পুরে পোয়াবারো হন রেলওয়ে এটেনডেন্ট, ডিউটিরত জিআরপি সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে সত্যিকারের চেকিং হয় যারা সিটে বসে থাকেন শুধুমাত্র তাদের। এছাড়া, রেলওয়ে স্টাফের আত্মীয় পরিচয়ে কয়েক ডজন লোক ছাড় পান টিকিট না কেটে। অথচ তাদের কাছে কোন প্রকার পাশ থাকে না।

আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রীদের প্রতিদিনের ভোগান্তি দেখার কেউ না থাকলেও টাকা আদায়ের লোকের অভাব নেই। এখানে নিম্নমানের খাবার বিক্রি হয় অতিরিক্ত দামে। এসব অভিযোগ করেও কোন ফল পাওয়া যায় না। ঠিক যেন আগের লোকাল ট্রেনের অবস্থা আন্তঃনগর ট্রেনের। আন্তঃনগর ট্রেনের দুরবস্থা যেন সালেহার দুরবস্থার চেয়েও বেশি।

লেখক : এস এম আববাস, সাংবাদিক

জুলাই ২০০৯ সালের ঘটনা নিয়ে লেখা।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.