ধর্মীয় অনুভূতির ভূত আবিষ্কার মাউশির

এপ্রিল ১৯, ২০২৩

 

এস এম আববাস

জাতি-গোষ্ঠী আর সম্প্রদায় এক করে দেখবেন না। সংস্কৃতিচর্চা আর ধর্মচর্চা একসঙ্গে ঘেঁটে ‘স্যালাইন’ বানাবেন না। স্যালাইন ডিহাইড্রেশন দূর করতে কাজে লাগে, কিন্তু ধর্মচর্চা আর সংস্কৃতিচর্চা একসঙ্গে মিশিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে সমস্যা কমে না, বরং বাড়ে। সংস্কৃতিচর্চা আর ধর্মচর্চা এক করে ‘স্যালাইন ফরমুলা’ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতিচর্চায় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়াবেন না।

কথাগুলো বলছি যারা মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা করছেন তাদের জন্য এবং সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার উদ্দেশ্যে। সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা যাবে নাকি যাবে না তা নিয়ে পুরো জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর। বিভ্রান্ত করেই বসে থাকেনি, বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনে ধর্মীয় অনুভূতি আবিষ্কার করে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক এবং উগ্র ধর্মীয় চেতনাধারীরাও মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন।

এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। বাংলা নববর্ষ পালনে মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে এক ব্যক্তি আইনি নোটিশ করেছেন সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করে। আইনি নোটিশে তিনি উল্লেখ করেছেন—“মঙ্গল শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক-এর সরাসরি লঙ্ঘন। এটা দণ্ডবিধির (Penal Code) ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধও।”

প্রথমেই বলতে চাই, বাংলা ভাষা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না নিয়ে মঙ্গল শব্দের অর্থ এবং এর ব্যবহার নিয়ে আলোচনা উচিত নয়। অথচ আইনি নোটিশে মঙ্গল শব্দের সঙ্গে ধর্মীয় সংশ্লেষ আবিষ্কার করা হয়েছে। যেকোনও ভাষার শব্দই সাধারণভাবে ধর্মীয় শব্দ হয় না। ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা শব্দগুলোকে আমরা সাধারণভাবে ধর্মীয় শব্দ বলে থাকি। মনে রাখা দরকার, ভাষা সৃষ্টির আগে আনুষ্ঠানিক কোনও ধর্ম প্রসার লাভ করেনি। উকিল নোটিশ যিনি করেছেন তার ভাষা ও শব্দের ব্যুৎপত্তি পড়ে নেওয়া জরুরি বলে আমার মনে হয়।

এবার দেখা যাক সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদের ‘ক’-তে কী আছে। সংবিধানের ২ নম্বর অনুচ্ছেদের ‘ক’তে রয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন। ’

এই ধারায় মঙ্গল শোভাযাত্রা করা কোনও ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করা হয়নি, ধারা লঙ্ঘন তো প্রশ্নই ওঠে না। মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনও ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনে বাধা তৈরি করেনি বিগত বছরগুলোতে। এ বছরও করেনি। তাহলে কেন আইনি নোটিশ? নোটিশের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে আদালতে মামলা করলেই নোটিশকারী সঠিকভাবে তা বুঝতে পারবেন। আমি মামলার অপেক্ষায় থাকলাম।

এবার দেখবো দণ্ডবিধির ২৯৫-ক ধারায় কী বলা আছে। দণ্ডবিধির ২৯৫-ক ধারায় বলা হয়েছে, “প্রতিহিংসাবশতঃ কোনো শ্রেণির লোকের ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসের অবমাননা করা কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের নাগরিকবৃন্দের কোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ও হিংসাত্মকভাবে লিখিত বা উচ্চারিত কথা কর্তৃক বা দৃশ্যমান কোনো বস্তু কর্তৃক সে শ্রেণির ধর্মকে বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমানিত করে বা অপমানিত করার চেষ্টা করে, তবে সে ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।”

মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনের ক্ষেত্রে এই ধরার পরিপন্থি কোনও কিছুই নেই দেখা যাচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলা নববর্ষ পালনের অনুষঙ্গ। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে ইচ্ছাকৃত আঘাত বা আঘাত করার উদ্দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় না। কাউকে অপমানিতও করা হয় না। যদি কারও পছন্দ না হয় তাহলে তিনি নববর্ষে অংশ নাও নিতে পারেন, সেটি তার অধিকার। কিন্তু তিনি অযৌক্তিকভাবে নববর্ষ প্রচার বন্ধ করার ফন্দি আঁটতে পারেন না।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা করার নির্দেশনা চ্যালেঞ্জ করে একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক রিট পিটিশন করেন। সরকারের জারি করা চিঠি বেআইনি উল্লেখ তিনি রুল চেয়েছেন এবং রুলের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত চেয়েছেন। রিট আবেদনে সংবিধানের ১২ এবং ৪১ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ধর্মীয় স্বাধীনতার সঙ্গে চিঠি সাংঘর্ষিক উল্লেখ করা হয়েছে।

এবার দেখা যাক– সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে কী রয়েছে। সংবিধানের ১২ (ক) ধারায় বলা হয়েছে— “ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য, (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।”

সংবিধানের এই ধারা কোনোভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনের নির্দেশনা পরিপন্থি কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ধারা অনুযায়ী কোনও বৈষম্য সৃষ্টি বা নিপীড়নও করছে না মঙ্গল শোভাযাত্রা। বরং রাষ্ট্র কর্তৃক কোনও ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান করার বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করা যায়। কারণ, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংবিধানে আছে, আবার ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনের নির্দেশনা সাংঘর্ষিক নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালনের নির্দেশনা ধর্মীয় কোনও বিষয়কে মর্যাদা দেওয়া নয়। এটুকু বোধ না থাকলে নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে বলে আমার মনে হয়।

এবার দেখা যাক সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে কী বলা হয়েছে। সংবিধানের ৪১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে; (খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।”

এই ধারার পরিপন্থি কোনও কার্যকলাপ নেই মঙ্গল শোভাযাত্রায়। মঙ্গল শোভাযাত্রা কারও ধর্ম পালন বা প্রচার করতে নিষেধ করে না।

৪১ অনুচ্ছেদের ২-এ বলা হয়েছে— “কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।”

মঙ্গল শোভাযাত্রা ধর্মীয় কোনও অনুষ্ঠান নয়। তাছাড়া কোনও ব্যক্তি এমনকি শিক্ষার্থী না চাইলে তাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে কেউ বাধ্য করবে, এমন নির্দেশনা নেই শিক্ষা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের আদেশে। তাহলে কোন যুক্তিতে রিট করা হয়েছে? আসলে বিষয়টি আলোচনায় এনে নিজের প্রচার বাড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কি?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনের নির্দেশনা আলোচনা করতে একটি উদাহরণ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামি রীতি অনুসারে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় নোটিশ টানিয়ে। এতে কি অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য করা হয়? যদি তা না হয় তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নোটিশ করে বা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অংশ বাংলাদেশের সংস্কৃতি পালনে নোটিশ করলে বৈষম্য হবে কেন?

গত দুই দিনে গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবরের তথ্য বলছে— মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের অধীনে পরিচালিত দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা গুরুত্বের সঙ্গে পালন করার জন্য আদেশ জারি করা হয়। আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এই আদেশ দিয়েছিল গত বুধবার (১২ এপ্রিল)। এই আদেশ জারির চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) আবার নতুন করে আরেকটা আদেশ জারি করে। পরে জারি করা আদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনের নির্দেশনা নেই। নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতি।

গত ১২ এপ্রিল মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনের আদেশ জারির পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়। রোদের মধ্যে শিশুদের মঙ্গল শোভাযাত্রার নির্দেশনার সমালোচনার পক্ষে সহমত প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। দ্বিতীয় আদেশ জারির পর আমার মনে হয়েছিল রোদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের কষ্টের কথা ভেবে হয়তো নতুন আদেশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। শিক্ষার্থীরা আড়ম্বরের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ পালনে অংশ নেবে তা নতুন আদেশেও রাখা হয়েছে। তাহলে আগের দিনের আদেশ বাদ দিয়ে নতুন করে আদেশ জারি করা হলো কেন?

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত ১২ এপ্রিলের আদেশে বলা হয়েছে—‘নববর্ষ ১৪৩০ উদযাপন অনুষ্ঠান আবশ্যিকভাবে জাতীয় জাতীয় সংগীত ও ‘এসো হে বৈশাখ’ গান পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু করতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ও যথাযথ আড়ম্বরে নববর্ষ উদযাপন করবে। ইউনেস্কো কর্তৃক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে প্রচার করতে হবে। সকালে আবশ্যিকভাবে শিক্ষার্থীদের মাঠে র‌্যালি করতে হবে।’

পরের দিন ১৩ এপ্রিলের নতুন আদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা করার অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছে। আর নতুন করে যোগ করা হয়েছে—‘অনুষ্ঠানে পবিত্র রমজানের পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা করতে হবে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করে ধর্মীয় অনুভূতি বজায় রেখে যথাযথ আড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবে।’

এখানে লক্ষণীয় যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাদ দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতি বজায় রেখে বাংলা নববর্ষ আড়ম্বরে উদযাপন করতে বলা হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাদ দিয়ে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ যুক্ত করতে হলো কেন? প্রথম আদেশে যদি রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করার উল্লেখ করা হতো, মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনের নির্দেশনাসহ রমজানের পবিত্রতা রক্ষার কথা আদেশে থাকতো, তাহলে কেউ আপত্তি করতো বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া মঙ্গল শোভাযাত্রা পালনের নির্দেশনা থাকার পরও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ছাড়া কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রার সরাসরি বিরোধিতা করেছে এমন খবর গ্রহণযোগ্য কোনও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি।

আমি প্রথমেই বলেছি– জাতি-গোষ্ঠী আর সম্প্রদায় এক না করতে। এটি করার কোনও যুক্তি নেই। মনে রাখা দরকার, ধর্মতত্ত্ব কোনও যুক্তি মেনে চলে না। এখানে বিশ্বাসই একমাত্র বিষয়। যারা বিশ্বাস করেন তারা মেনে চলেন। তাই বলে পাঠ্যক্রম থেকে যুক্তিবিদ্যা বা দর্শন পড়া বাদ দিতে হবে এমন কথা কেউ দাবি করেনি। জ্ঞান অর্জনের জন্য বিজ্ঞান-দর্শন বাদ দেওয়ার কোনও সুযোগও নেই।

এখন ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে যদি কেউ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম থেকে দর্শন বা যুক্তিবিদ্যা বিষয় বাদ দেওয়ার দাবি তোলেন, তাহলে সচেতন কোনও মানুষ মেনে নেবে কি? সাম্প্রদায়িক চেতনার কোনও ব্যক্তি হয়তো বিরোধিতা করতে পারেন।

পাঠককে আরও কিছু তথ্য দিতে চাই। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন করে আদেশ জারি করেছে পরের দিন ১৩ এপ্রিল। নতুন আদেশে বলা হয়, মাহে রমজানের পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে জাতীয় সংগীত পরিবেশন, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ-১৪৩০ উদযাপন করতে হবে।

মাদ্রাসা অধিদফতর মঙ্গল শোভাযাত্রা আদেশ থেকে বাদ দিলেও ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ আবিষ্কার করেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের অধীনে মাদ্রাসা পরিচালিত হয় না। তারপরও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মাথায় ‘ধর্মীয় অনুভূতি’র ভূত চাপলো কীভাবে?

তবে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরকে। নতুন করে আদেশ জারি করেনি সংস্থাটি। আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের আদেশ দিয়েছিল, তা আজ অবধি বহাল আছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিনটি অধিদফতরের আদেশগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাদ দিয়ে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের। মৌলবাদীদের চিন্তা মাথায় নিয়ে অথবা মৌলবাদীদের ভয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ অমান্য করা হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের নির্দেশনা মতো দেশের সংস্কৃতিচর্চা চলে না। দেশীয় সংস্কৃতি দেশের শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে, এই দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এড়িয়ে যেতে পারে না। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে দেশিও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করতে পারে না।

২০১৬ সালে ইউনেস্কো যখন মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তালিকাভুক্ত করে, তখন দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে দেশপ্রেমে। সরকার ২০১৬ সাল থেকে প্রচার প্রচারণায় রেখেছে। এখন হঠাৎ কেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের দেশপ্রেম, দেশীয় সংস্কৃতিচর্চা কেন বাদ দেওয়া হলো? জাতির কাছে এই কৈফিয়ত নিশ্চয় দেবেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের কর্ণধাররা।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন