ভাষাসৈনিক শামসুদ্দিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলবে কবে?

মার্চ ২১, ২০২৩

আশীষ কুমার দে:

‘‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’’

…. ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন নিয়ে কালজয়ী এ গানের রচয়িতা চারণকবি শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ; যাঁর জন্ম হয়েছিল বাগেরহাট জেলার এক অজপাড়াগাঁয়ে। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তাঁর কর্মবহুল অমর স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা জানিয়ে এ প্রসঙ্গে দু-চারটি কথা লিখছি।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশ যখন উত্তাল, মায়ের মুখের বোল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দাবিতে বাংলার দামাল ছেলেরা যখন রাজপথে অকাতরে রক্ত ঝরাচ্ছিলেন, তখন অজপাড়াগাঁয়ের এই শামসুদ্দিনও নিজের লেখনি নিয়ে শরিক হয়েছিলেন সেই আন্দোলনে। তিনি লেখেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলি বাঙালি, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।

www.bahannonews.com
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে লেখা এ গানটি পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধেও এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সাত দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও শামসুদ্দিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি।

তিনি রাষ্ট্রভাষা গানটি লেখেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে; যেদিন পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকায় ছাত্রমিছিলে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করেছিল। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন শেষে শহরের সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক মাঠে এক সমাবেশ হয়। সেখানে নিজের লেখা বিদ্রোহের গানটি গেয়ে ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন শামসুদ্দিন।

শুধু একদিন নয়, পরবর্তী সময়ে বেশ কিছুদিন শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে এ গান গেয়ে ভাষা অন্দোলনে গতি সঞ্চার করেন তিনি। গানটি অল্প সময়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের পর রাষ্ট্রভাষা গানটি দেশের অনেক গুণীশিল্পীর কণ্ঠেও পরিবেশিত হয়েছে।

শেখ শামসুদ্দিন ১৯১৫ সালের ১৮ এপ্রিল বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট টাউন স্কুল নামে পরিচিত বাগেরহাট বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে; যা এখন বাগেরহাট বহুমুখী কলেজিয়েট স্কুল। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনার পর আর্থিক অনটনের কারণে ইতি টানতে হয় তাঁর।

শৈশব থেকেই কবিতা ও গান লেখার প্রতি ঝোঁক ছিল শামসুদ্দিনের। পল্লীগীতির সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের ভক্ত ছিলেন তিনি। জনশ্রুতি আছে, শামসুদ্দিন খুচরা তেল বিক্রেতা ছিলেন। পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তেল বিক্রির ফাঁকে কবিতা ও গান রচনা করতেন, নিজেই সেগুলো পড়তেন ও গাইতেন। বাগেরহাটের গর্ব চারণকবি শেখ শামসুদ্দিনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। অভাবের সংসারে তাঁরাও পড়াশুনা করতে পারেননি।

কবির বড় ছেলে শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, আমার বাবা গরিব মানুষ ছিলেন। তিনি হাটবাজারে ফেরি করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। একইসঙ্গে গান লিখতেন। ভাষা আন্দোলন নিয়েও তিনি গান লিখেছেন। গানগুলো জনপ্রিয়ও ছিল। তবু তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি।

কবিপুত্র দেলোয়ার আরো জানান, রাষ্ট্রভাষা গানটি শামসুদ্দিন প্রথমে লোকসুরে গেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটিতে কণ্ঠ দেন রথীন্দ্রনাথ রায়। গানটি একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা হলেও এ গান মহান মুক্তিযুদ্ধেও দেশবাসীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর চারণকবি শামসুদ্দিনের জীবনাবসান ঘটে। এরপর তাঁকে বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কের পাশে নিজগ্রাম ফতেপুরের পৈতৃক ভিটায় সমাহিত করা হয়। কবির স্মৃতি হিসেবে তাঁর ব্যবহৃত একটি একতারা এখনো আগলে রেখেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

বাগেরহাটের সর্বস্তরের মানুষ দীর্ঘদিন যাবত অমর ভাষাসৈনিক চারণকবি শেখ শামসুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, যাঁর ক্ষুরধার লেখনী ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র জাতিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল, তাঁর কৃতকর্মের স্বীকৃতি দীর্ঘ ৭১ বছরে দেয়নি রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে আমার সবিনয় প্রশ্ন- ভাষাসৈনিক শামসুদ্দিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলবে কবে?

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও লেখক।