পরীক্ষায় পাশ-ফেলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হওয়া

ডিসেম্বর ৭, ২০২২

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী || অভিনন্দন, আনন্দ ও উৎসবে মেতেছে যখন পরীক্ষায় পাশ করা শিক্ষার্থীরা, ঠিক তখন মনে পড়ছে পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীদের কথা। কতটা দুঃসহ হয়ে উঠেছে আজ তাদের জীবন। নীরবে, নিভৃতে পাদ প্রদীবের নিচে চাপা পড়েছে আজ তাদের উজ্জ্বল মুখগুলো।

অদ্ভুত এই সমাজ, তাদের ব্যর্থতায় তাদের অপরাধী বানাতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছেনা, অথচ তাদের এই ব্যর্থতার জন্য সমাজের দায় কতটুকু তার বিচার কেউ করছেনা। যে শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে রেখেছি, কেউ চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দেবার মতো মনোভাবও দেখাতে পারছেনা। যত দোষ নন্দ ঘোষ।বরং খুতিয়ে খুতিয়ে ওদের ভালো দিকগুলো বাদ দিয়ে মন্দ দিকগুলো নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে।

ওদের জন্য খুব কষ্ট লাগছে, ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আজ সাহস আর প্রেরণা যুগানোর কথা থাকলেও আমাদের ঘুনে ধরা মন তা পারেনি। সাহসীরা অন্ধকারে পথ দেখাতে পারে, কাপুরুষরা আলোতেও পথ খুঁজে পায়না-এ কথাগুলো আমাদের সমাজে অচল পয়সার মতো।সবচেয়ে বড় কথা পরীক্ষায় পাশ করা আর সফলতা এক কথা নয়। জীবন পরীক্ষায় উৎরে গিয়ে কারা আগামীদিনের বাতিঘর হয়ে উঠবে তা হয়তো সময়েই বলে দিবে। পৃথিবীর ইতিহাসও তাই বলে। ব্যর্থরা যদি জড়তা ভেঙে জেগে উঠতে পারে তবে পৃথিবী বদলে দেবার ইতিহাসের মশালটা তাদের হাত দিয়েই জ্বলে উঠে। আর পরীক্ষায় পাশ-ফেল করলেই সবাই ভালো মানুষ হয়না, পরীক্ষায় পাশ-ফেলের চাইতে ভালো একটা মানুষ হয়ে উঠাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।যেখানে মানুষের খেয়াল-খুশিতে বানানো পরীক্ষার প্রয়োজন হয়না, মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় লড়ার মতো আত্মশক্তির প্রয়োজন হয়।

সময় যতই গড়িয়েছে ফেলের সাথে পাল্লা দিয়ে ততই পাশের সংখ্যা বেড়েছে।কিন্তু প্রকৃত মেধাবী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে কি? ঠিক উল্টো দেখছি, সময় যতই গড়িয়েছে ততই মেধাবীদের সংখ্যা কমেছে, পাশের হার বেড়েছে।কেন এমনটা হচ্ছে, সেটা নিয়েই বেশি ভাবা দরকার।আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি কি পারছে প্রকৃত মেধাবীদের বের করে আনতে, নাকি শিক্ষার অদ্ভুত আবরণে-আচরণে প্রকৃত মেধাবীরা হারিয়ে যাচ্ছে ?

হয়তো আমরা যাদের মেধাবী ভাবছি তারা মেধাবী নয়, যাদের আমরা অমেধাবী ভাবছি হয়তো তারাই মেধাবী। কোথাও না কোথাও তো একটা গন্ডগোল আছে, সেটা যেন দম হারানো ফুটবল না হয়ে যায়।নষ্ট সমাজের পচনটাও এর জন্য সমান দায়ী। কত ফুল ফোটাবার আগে হারিয়ে যাচ্ছে নষ্ট সমাজের চোরাবালিতে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

আমাদের দরকার মেধার চর্চা করা, প্রতিভাধর মানুষদের গড়া, আলোকিত মানুষের জন্ম দেওয়া, সুস্থ সমাজ তৈরী করা, যেখানে পরীক্ষার চেয়ে মানুষের সৃষ্টিশীল চিন্তার মূল্য হবে অনেক বেশি।

ভেঙে যাক অচলায়তন, বেরিয়ে আসুক প্রকৃত চিন্তাশক্তির অভূতপূর্ব উদ্ভাবন।তারপরও দিন যায় কথা থাকে….কথা থেকে যায়।

লেখক: কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।