নারী ভাইস-চেয়ারম্যানদের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত অভাব-অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান

ডিসেম্বর ২, ২০২২

শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে ঢাকা বিভাগের উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর ফলপপ্রসূ অংশগ্রহণ: নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের ভূমিক ‘ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

মহিলা পরিষদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন শান্তি।

প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য শিরীন আখতার, অনলাইনে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের  সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিম আক্তার হোসাইন।

আরও বক্তব্য রাখেন মধুখালী উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুরাইয়া সালাম।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে তার স্বীকৃতি আমরা পেয়েছি। মর্যাদা, অধিকার ও ক্ষমতার জন্য এখন লড়াই করতে হবে। নারীরা মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতিতে এসেছে।

নারী ভাইস-চেয়ারম্যানদের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত অভাব-অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে ডা. ফওজিয়া মোসলেম  বলেন,  ‘কাজের প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবদ্ধ নিয়ম আছে এগুলো জেনে কাজ করতে হবে। নিজ দায়িত্ব বোঝার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার কীভাবে কাজ করতে পারে, শক্তিশালী হতে পারে সেদিক নিজ বিবেচনায় রাখতে হবে। ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে কীভাবে কাজ করতে হবে তা কাজ করার মাধ্যমেই শিখতে হবে। ক্ষমতায়ন হলো আমি আমার শর্তে বাঁচতে চাই।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ক্ষমতায় বঞ্চনার বিষয়টি সবসময় ছিলো। এটা থাকবে যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থায় অধিকারকে আদায় করে নিতে হবে। আর আগের চেয়ে বর্তমানে থাকা অবস্থাকে বিবেচনা করতে হবে। পরিষদে বর্তমান থাকা পরিপত্র পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সংকট থাকবে না। এখন ও পর্যন্ত বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক সংকট আছে। যেটুকু ক্ষমতা পাওয়া গেছে একে কিভাবে পরিষদ কেন্দ্রিক করা যায় সেলক্ষ্যে কাজ করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে থাকা পাঁচ স্তরকে কমিয়ে তিনটি স্তরে নিয়ে আসলে সকলে কাজ করার কিছু সুযোগ পাবে।

উপজেলা পরিষদের পরিপত্র অনুযায়ী প্রদত্ত ক্ষমতা অনুসারে নারী- ভাইস চেয়ারম্যানদের কাজ করার আহ্বান জানান প্রতিমন্ত্রী।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য শিরীন আখতার বলেন, ক্ষমতায়নের প্রশ্নে নারী ও পুরুষের উভয়ের কথাই বলতে হবে। নারীরা সংগ্রাম করলেও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে কেবল পুরুষকেই দেখা যায়। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে হলে প্রথমে উপজেলার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, জেলা উপজেলার মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। একজন পুরুষ চেয়ারম্যানের সঙ্গে নারী ভাইস চেয়ারম্যানকে যুক্ত করার মত বড় দৃশ্যমান অর্জনকে সঙ্গে নিয়ে আগাতে হবে। প্রশাসনিক ত্রুটি, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি দেশকে রক্ষা করা জরুরি। নয়তো নারীর জন্য আসা অর্জনটুকু ও থাকবে না।

সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদ বলেন,  আমরা চাই নারী প্রতিনিধিরা যেন একটি সম্মানজনক অবস্থানে থাকেন । তারা একজন সাংসদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। নারীদের দায়িত্ব দিলে তা সঠিকভাবে পালন করতে পারে।

তাদের বরাদ্দ ও দায়িত্বগুলি কেন্দ্র থেকে সকল ভাইসচেয়ারম্যানদের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টন করে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান সেলিমা আহমেদ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের  সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে দীর্ঘ সংগ্রামের প্রয়োজন হয়েছে। উপজেলা বিকেন্দ্রীকরণের একটি স্তর। উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত জরুরি। আলোচনায় আসা সমস্যা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নারী জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা ও সম্মান এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। ক্ষমতায়ন এখনো হয়নি।  অবশ্যই নারীর ভূমিকা  ও দায়িত্ব উপজেলা পরিষদ ম্যানুয়ালে ও প্রজ্ঞাপনে  থাকতে হবে। উপজেলা অফিসে থাকা সম্পদের ব্যবহার নারীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। ১৭টি স্ট্যাডিং কমিটির কাজ ও সিদ্ধান্ত মনিটরিং এর দায়িত্ব নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের দিতে হবে। ক্ষমতায়নের জন্য ক্ষমতা শেয়ার করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

মধুখালী উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুরাইয়া সালাম বলেন, ‘নারী-পুরুষের জন্য থাকা বরাদ্দ বৈষম্য দূর করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে কেননা নির্বাচনী ব্যয়  পুরুষ ও নারী প্রার্থীর জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল যা বহন করা সম্ভব না।’

স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বহুমুখী কাজ পরিচালনা করছে। দীর্ঘদিনের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের আন্দোলন হিসেবে আজ রাজনীতিতে নারীদের উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়েছে। রাষ্ট্রপরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ মনে করে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বলতে কেবল পদে অধিষ্ঠিত হওয়া নয়।  নিজ প্রত্যাশা অনুযায়ী  নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিরা কাজ করতে পারছেন কিনা, নারীর জন্য নির্ধারিত  সামাজিক ছক থেকে বেরিয়ে কাঠামোগত বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজেকে এজেন্সি হিসেবে প্রতিষ্ঠা  কাজ করতে পারছেন কিনা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সামগ্রিকভাবে নারীর উপস্থিতি, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে পারেছেন কিনা তা আলোচনার লক্ষ্যে আজকের মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নারীর ক্ষমতায়নের একটি অন্যতম শর্ত হলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীতি, আইন এবং বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে ২০০৯ সালে প্রথমবারে মতো বাংলাদেশে উপজেলা পরিষদে একটি আসন মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদের জন্য সংরক্ষিত রাখার বিধানের মাধ্যমে  রাষ্ট্র পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আর এক ধাপ অগ্রগতি সাধিত হয়।  নিজেদের মেধা ও শ্রমের সমন্বয়ে নারীরা এই পদে অধিষ্ঠিত হন। এসময় তাদের কাজের নানা ক্ষেত্র সমূহের উল্লেখ করে বলা হয় নারী ভাইস-চেয়ারম্যানরা এক বা একাধিক কমিটির সভাপতি হওয়া ছাড়াও চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপন, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, সমবায় সমিতি, সমাজকল্যাণ ও জনহিতকর কার্যক্রম, নারী শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, যৌতুক ও বাল্য বিবাহ রোধকল্পে ভূমিকা পালন করবেন বলে বিধিমালায় উল্লেখ  থাকলেও দায়িত্ব বিভাজনের ক্ষেত্রে এক ধরনের জেন্ডার পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়,  যা কিনা সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রতিফলন। এসময় লিখিত বক্তব্যে নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের কাজের ক্ষেত্রে থাকা প্রতিবন্ধকতাগুলোর উল্লেখ করে তা দূরীকরণের জন্য কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়।

উপস্থিত ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিভাগীয় শিবপুর উপজেলার তাপসী রাবেয়া নারী, গাজীপুর কাপাসিয়া উপজেলার রওশন আরা বেগম,  সাভারের ইয়াসমিন আক্তার সুমি, রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার রোকেয়া বেগম , কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাসুমা আক্তার, ফরিদপুর বোয়ালমারী উপজেলার মোছা. রেখা, নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার সামিনা হোসেন, গাজীপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রীনা পারভীন, নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার শারমিন আক্তার, ধামরাই উপজেলার সোহানা জেসমিন, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার গুলনাহার।