ইরানে নারী অধিকার দমনে চরিত্রহননের পুরোনো কৌশল

অক্টোবর ৮, ২০২২

‘আপনি কি জানেন রাস্তায় মাথার স্কার্ফ খুলে নাচিয়ে বেড়ানো গুটিকয়েক নারী কী চান?… তারা একমাত্র যে ‘স্বাধীনতাটি’ চান তা হলো প্রতি রাতে কারও সঙ্গে ঘুমানো এবং পশুর মতো আচরণ করা’- মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে ইরানজুড়ে পোশাকের স্বাধীনতা দাবিতে রাস্তায় নামা নারীদের সম্পর্কে এমনটাই বলেছেন দেশটির পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য হামিদ রাসাই।

নারীদের নিয়ে শাসকগোষ্ঠীসংশ্লিষ্টদের এমন অবমাননাকর মন্তব্য ইরানে অতিপরিচিত। এর আগেও নারী স্বাধীনতা প্রশ্নে বিভিন্ন আন্দোলনের সময় দেশটির উচ্চপদস্থরা এমন অসংখ্য মন্তব্য করেছেন।

নারীদের অধিকারের বিষয়টি আড়াল করতে যৌন সুড়সুড়িমূলক ব্যাঙ্গ নিয়মিত ঘটনা। আন্দোলনকারীদের ‘নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে’ বা তারা ‘যৌনকর্মী’ এমন কথাও বলা হয়েছে।

ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি এবং উচ্চপদস্থ নেতারা বহুবার বিরোধীদের, বিশেষ করে নারীর বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে যৌনতাসূচক অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করেছেন। এমনকি খোমেনিবিরোধী অন্য ইসলামি দলগুলোকে পর্যুদস্ত করতেও এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।

www.bahannonews.com
১৯৮০-এর দশকে তেহরানের প্রসিকিউটর আসাদুল্লাহ লাজেভার্দি দাবি করেছিলেন- নিষিদ্ধ ঘোষিত পিপলস মোজাহেদিন অর্গানাইজেশনের (এমইকে) কর্মীদের বাড়িতে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি পাওয়া গেছে।

তবে যৌনতাকেন্দ্রিক অবমাননাকর অভিযোগের মাধ্যমে বিরোধীদের কোনঠাসা করার অস্ত্র ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়ছে ইরানে। দেশটিতে এখন ব্যক্তিগত পছন্দ এবং যৌনতা আগের মতো ট্যাব্যু হিসেবে নেই। এমনকি যৌন সুড়সুড়িমূলক কথাবার্তা মানুষকে তেমন আলোড়িতও করে না। ফলে এবারের আন্দোলনে নারীর মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা খুব একটা সফল হচ্ছে না।

এর পরেও হামিদ রাসাইয়ের মতো আরো অনেক কট্টরপন্থি হাল ছাড়েননি। দেশটির বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত হোসেন কাচুয়ান তাদের একজন। চলমান আন্দোলনের জনপ্রিয় একটি স্লোগান- ‘জিন, জিয়ান, আজাদি’; যার অর্থ ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। হোসেন কাচুয়ান একে বদলে দিয়ে বলছেন, ‘নারী, যৌনবৃত্তি, লাম্পট্য’।

এর আগে ২০১৮ সালে বিপ্লবী রেভিলিউশনারি গার্ডের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক জেনারেল মোহাম্মদ রেজা নাগদি হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ‘যৌনকর্মী’ বলে আখ্যায়িত করেন।

নাগদি সে সময় বলেছিলেন, ‘তারা (পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম) ‘বাধ্যতামূলক হিজাববিরোধী’ হিসেবে যাদের তুলে ধরছে তারা আসলে যৌনকর্মী, এমনকি একই ভুল আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমও করছে।’

ইরানে নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠ দমনে শুরু থেকেই ইসলামি প্রজাতন্ত্রটির শাসকগোষ্ঠী যৌনতাকেন্দ্রিক ‘কলঙ্ককে’ অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, এমনকি উদার ইসলামি দলগুলোও এই অস্ত্র থেকে রেহাই পায়নি।

ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়া আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি শুরুর দিকে বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরোধী নারীদের উদ্দেশে বলতেন, তারা শাহ শাসনামলের ‘নগ্নতা’, ‘নৈতিক অবক্ষয়’ ও ‘যৌনকর্ম’ ফিরিয়ে আনতে চান।

এই অভিযোগের তীর পরে বিরোধী রাজনৈতিক বা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দিকেও বর্ষিত হতে শুরু করে, যদিও এসব গোষ্ঠীর কর্মীদের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের যৌন সম্পর্কের বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল।

শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌনতাকেন্দ্রিক প্রকাশ্য গালগল্প প্রচার করা ছাড়াও রাজনৈতিক বন্দিদের কাছ থেকে জোর করে যৌন সম্পর্কের স্বীকারোক্তি নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

খোমেনি বারবার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেছেন, ‘স্বাধীনতা’ বলতে তারা যেটি বোঝাতে চান সেটা আসলে পশ্চিমা অনুকরণের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা ‘দুর্নীতি ও যৌনতার’ স্বাধীনতা।

১৯৭৯ সালে এক বক্তৃতায় খোমেনি বলেন, “তারা (বিরোধীরা) চায় আমাদের তরুণেরা ‘মুক্ত’ হোক। তারা চায় জুয়ার আসর অবাধে উন্মুক্ত থাকুক, মদের আসর উন্মুক্ত থাকুক, বেলেল্লাপনা অবাধে উন্মুক্ত থাকুক, হেরোইনের আড্ডা উন্মুক্ত হোক, আফিমের আসরে কেউ বাধা না দিক …।

‘তারা যেসব কিছুর মধ্যে স্বাধীনতা দেখে, তার সবই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তারা নারী-পুরুষের স্বাধীনতা চায়, উদোম দেহে সাগরে একসঙ্গে সাঁতার কাটতে চায়। যৌনকর্মীর ঘরে একত্রিত হয়ে তারা বলতে চায় এর নামই হলো যা খুশি তা করা।’

দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা ১৯৮০-এর দশকে ‘পশ্চিমা স্বাধীনতা’ প্রতিহত করার দিকে মনযোগ দেন। তারা বলতে শুরু করেন নারী অধিকারের সমর্থকরা প্রকৃতপক্ষে নারীর ‘যৌন দাসত্বের’ সমর্থক।

তাদেরই একজন আলি আকবর হাশেমি রাফসানজানি পরে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৪ সালে এক জুমার নামাজের খুতবায় বলেন, ‘পশ্চিমারা যখন অন্তর্বাস বা হাফপ্যান্ট প্রদর্শনের জন্য দোকানের জানালার পিছনে নারীর ম্যানিকিন সাজিয়ে রাখে তখন কি নারীরা সম্মানিত বা মুক্ত হয়?’

ইরারেন শাসকগোষ্ঠী যৌনতাকেন্দ্রিক অস্ত্র নাগরিক অধিকারের সমর্থকদের পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতাদের ওপরের প্রয়োগ করেছে। এই দলগুলো ইসলামি বিপ্লবের আগে শাহ শাসনের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছে।

তেহরানের প্রসিকিউটর আসাদুল্লাহ লাজেভার্দিসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তারা বারবার নিষিদ্ধঘোষিত এমইকে-এর সেফ হাউসে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি পাওয়ার কথা বলেছেন। খোমেনি সমর্থক লেখক মোজতবা সোলতানি এক বক্তৃতায় দাবি করেন, ওইসব সেফ হাউজে এমইকে-এর পুরুষ কর্মীরা সমকামী সম্পর্কেও জড়িত।

তবে এমইকে-এর মতো গেরিলা গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে সে সময় যৌনসম্পর্কের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ ছিল। বামপন্থি গেরিলা গোষ্ঠী ইরানি পিপলস ফেদাইয়ের সদস্য আবদুল্লাহ পাঞ্জে-শাহী নিজ সংগঠনের এক নারী কর্মী এডনা সাবেতের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোয় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার নজিরও রয়েছে।

যৌনতাকেন্দ্রিক গালগল্প প্রচার করে ইরানে ভিন্নমত দমনের কৌশল ১৯৯০-এর দশকে আরও তীব্র হয়। ভিন্নমতাবলম্বী লেখক ও সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা একের পর এক এ ধরনের অভিযোগের মুখে পড়তে থাকেন।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ১৯৯৬ সালে হোভায়াত বা আইডেন্টিটি নামে একটি পাক্ষিক অনুষ্ঠান শুরু করে। এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল, ‘পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবিলা।’

এই অনুষ্ঠানে ইরানি বুদ্ধিজীবী (ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিকতাবাদী), প্রত্নতাত্ত্বিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং জাতীয় নেতাদের একটি বড় অংশকে হেনস্তার লক্ষ্যে পরিণত করা হয়।

অনুষ্ঠানটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ইরানের ইসলামিক রিপাবলিক ব্রডকাস্টিংয়ের (আইআরআইবি) প্রধান আলী লারিজানি বলেন, ‘অনুষ্ঠানে যে সমস্ত লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের আক্রমণ করা হয়েছে তাদের সবার কাজের মান ছিল নিম্নাঙ্গ (আন্ডারবেলি) সমতুল্য।’

এ ধরনের অভিযোগ ১৯৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সংস্কারপন্থি মোহাম্মদ খাতামির বিরুদ্ধেও ছড়ানো হয়েছিল। হিজবুল্লাহ প্রেস একটি বইয়ের কিছু অংশ প্রকাশ করে, যাকে ‘অশ্লীল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। খাতামি সংস্কৃতি ও ইসলামিক গাইডেন্স মন্ত্রী থাকার সময়ে বইটি প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল, যাতে করে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ভোট তার পক্ষে না যায়।

পরে খাতামি আট বছর প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি ও তার সমর্থকেরা বারবার অভিযোগ করেছেন, একদল লোক স্বাধীনতার নামে ‘অশ্লীলতা এবং যৌনবৃত্তির’ প্রসার ঘটাতে চায়।

খাতামি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০০০ সালে মন্ত্রিসভার সঙ্গে এক বৈঠকে খামেনি বলেন, ‘বহুল অপব্যবহৃত ‘স্বাধীনতা’ শব্দের জন্য আমাদের অবশ্যই চোখের পানি ফেলতে হবে। স্বাধীনতার নামে কিছু লোক সমাজে পাপ কাজ, যৌনবৃত্তি এবং লাম্পট্যের প্রচার চালাচ্ছে। এর ফল হলো, জনগণের কাছে সরকার সমালোচিত হবে।’