তোমার শৌর্যে মুছে গেছে আগুনের দিনলিপি

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২

অনেকবছর আগের কথা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। স্কুলে পড়ি তখন। তাই স্মৃতি অনেকটাই ঝাপসা। তবে মনে দাগ কাটার মতো ঘটনাগুলো কখনো পুরোপুরি ভোলা যায় না। তখন তো রাজনীতিও বুঝি না, কবিতাও লিখি না। পরিবারের কড়া শাসনে লেখাপড়া করি, সুযোগ পেলে দুষ্টুমি। ছুটি পেলে নানা-দাদার গ্রামে গ্রামে ঘুরি। এমনই একটা সময় ছিল সেটা। যৌথ পরিবারের বাড়িতে থাকা ভাগিগোষ্ঠী মামা-খালার সংখ্যা দুই থেকে আড়াই ডজনের কম না। হুট করেই বিকালের পর থেকে পাশের গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো সবাই। সেটা আবার আত্মীয়ের বাড়ি। সেহেতু আমিও খুব উৎসাহ নিয়ে গেলাম। দলবেধে যাওয়ার পর দেখি, বিরাট উঠানজুড়ে বসার মতো জায়গা রেখে বাড়ির এককোণে একটা টিভি সেট করা। সন্ধ্যার পর ভিড় বাড়তে থাকলো। বিদ্যুৎ নেই। ব্যাটারি দিয়ে চালানো হলো সাদাকালো টেলিভিশন। আমার আগ্রহ ছিল না খুব একটা। নিজের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এরমধ্যেই একটা প্রমাণ্যচিত্র দেখানো শুরু হলো। লোকারণ্য হয়ে উঠলো উঠান। কারো চোখ ছলছল, কারো কারো চোখে জল। যতোবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি আরও বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হচ্ছিলো, ততোবারই আশেপাশের অনেককে চোখ মুছতে দেখলাম। পাশ থেকে অনেকেই আমাকে বলে দিচ্ছিলো এটা ওটা। বঙ্গবন্ধুকে টিভি পর্দায় সেদিনই আমার প্রথম দেখা। সেদিনই সেভাবে প্রথম শুনেছি সেই বজ্রকণ্ঠী ভাষণ, কিছু কিছু অংশ বারবার দেখানো হচ্ছিলো। সেদিনই প্রথম দেখেছি শেখ হাসিনার চোখে জল, মনে গেঁথে গেছে সেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ আর মায়াভরা চেহারা। সবশেষে, গ্রামের নিরক্ষর বৃদ্ধা থেকে শুরু করে গৃহিণী, দিনমজুর, ভবঘুরে, আমজনতা, সবার চোখে মুখে অন্যরকম আভা। ‘শেখের বেটি হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হছে’ তারপরও তার চোখে-মুখে-কণ্ঠে ভেসে ওঠা নিখাঁদ নিঃস্বতার সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে ফেলেছিল উপস্থিতিরা। অনেকের কথোপকথোনগুলো ছিল অনেকটা এমন-‘দ্যাখ, কোনো কৃত্রিমতা নেই। হাসে, কাঁদে, সব আমাদের মতো। কী মায়া মায়া মিষ্টি চেহারা।’ এমন কারো জন্যই যেনো বহুকাল ধরে অপেক্ষা করছিল তারা।

এরপর দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে। ২০১৩ সাল। সেই স্কুলের আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে রাজনীতি গবেষণায় যুক্ত হয়েছি। ওই সূত্র ধরেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কিছুদিন পর, সম্ভবত ২০১৪ সালের মার্চে, একদিন গণভবনের দাওয়াতে গেলাম। বিশাল হায়-হুলাট কারবার। চারপাশে সাজানো অনেক পদের বাহারি খাবার। একদিকে স্টেজে চলছে গান, কবিতা, কথা। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের মানুষরা করছে ভাব বিনিময়। ঘুরে দেখতে দেখতেই কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। এখানে ওখানে দুষ্টুমি করছি। এরমধ্যেই হুট করে পাশে একটা জটলা দেখে মনোযোগ দেই। দেখি, সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে কী অবলীলায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন শেখ হাসিনা। আমার মতো অন্য আরও অতিথিরা অনেকেই তার আশেপাশে হাঁটছেন, কথা বলছেন। শেখ হাসিনাকে এতো কাছে থেকে দেখে অবাক হইনি। দাওয়াত যেহেতু, দেখা তো হওয়ারই কথা। কিন্তু তাই বলে এভাবে! এটা ধারনার বাইরে। আট-দশ হাত দূরত্ব রেখে আমি উনার আগে আগে হাঁটতে থাকি, আর মুগ্ধ হয়ে দেখি। এভাবে পুরো মাঠটা চক্কর দিলাম।

প্রধানমন্ত্রী পুরোটা সময়জুড়েই একটু পরপর সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে গেলেন। ভ্রু নাচিয়ে, চোখ হাসিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে গল্প করলেন সবার সঙ্গে। কোনো কৃত্রিমতা নেই। পুরো মাঠ হেঁটে গিয়ে খাবারের কর্নারে একবার ঢুঁ দিলেন। এরপর ভবনের একপাশে দাঁড়াতেই আমাদের কয়েকজনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। আমি তো এতোক্ষণ ধরে দেখতে দেখতে বিহ্বল হয়ে গেছি। আমার ঘোর তখনো কাটেনি। কী আর পরিচিত হবো! কিছুক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তিনি কী কী যেনো বললেন! অধিকাংশই মাথায় যায়নি, কী করে যাবে বলুন? আমি তো তখন পরাবাস্তবতায় ডুবে গেছি। একবার শেখের বেটিকে নিয়ে সেই ছোটবেলায় শুনে আসা গ্রামের বাতাসে ভাসতে থাকা কথাগুলির জীবন্ত প্রতিধ্বনি শুনছি, আরেকবার অপার মুগ্ধতায় নিমজ্জিত হয়েছি। তিনি যেনো আমাদের মন ভালো থাকা মায়েদের মতো চঞ্চলা, কখনো কখনো মনে হচ্ছিলো তিনি নাতি-নাতনিদের পরীক্ষায় পাস করার জন্য উপহারের ঘোষণা দেওয়া মধ্যবিত্ত নানিদের মতো প্রেমে ভরা, আবার কখনো কখনো তাকেই মনে হচ্ছিলো আমাদের হৃদয় নিংড়ানো সব ভালোবাসা টেনে নেওয়া কোনো মহীয়সী, যার চারপাশজুড়ে শুধুই মুগ্ধতা।

যাক, স্মৃতি থেকে ফিরতে হবে। শেখ হাসিনা আমার কাছে জাদুবাস্তবতা। তাকে নিয়ে লেখা কঠিন। এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। তার অন্যতম একটা কারণ হতে পারে, অভিতর্ক নির্মাণে আমাদের অনীহা। সেটা অবশ্য জাতিগতভাবে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানসে হাজার বছর ধরে চিত্তজুড়ে জেঁকে বসা অজানা ভয়ের সংস্কৃতির কারণে। সেই শৈশব থেকেই বাসনা ও প্রকাশকে পৃথক করে নিজেকে সহজাতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে শিখতে তা এখন আমাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যের অংশ। আমরা স্রোতের তালে তাল মিলিয়ে একটা গতানুগতিক কিন্তু নিরানন্দ জীবনতরঙ্গে ভাসতে থাকি প্রতিনিয়ত। গতিশীল কিন্তু নিদারুণ স্থবির এই স্বভাবগত যাপিতজীবন আমাদের আবেগ-আহ্লাদ কিংবা কষ্ট-খেদের বিস্ফোরণকেও দাবিয়ে রাখে। পূর্বাপর ভাবতে ভাবতেই আমদের জড়-জীবনে সায়াহ্নের ছায়া পড়ে। তারপর হৃদয়ের ককপিটে লুকিয়ে থাকা অনিরুদ্ধ গুপ্তধন খোঁজার স্বর্ণালি সময়গুলো হারিয়ে যাওয়ার পরে কিসের স্মৃতি যেনো হাতড়াতে বসি? অতঃপর, সবই শূন্য। কিন্তু শেখ হাসিনা আমাদের থেকে ব্যতিক্রম। তিনি অমিত সাহসী। তার বিক্রম আমার ভালো লাগে। তিনি অবলম্বন হতে পেরেছেন, একটা জাতির দুঃখদিনের অবলম্বন হয়েছেন। তিনি রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দিতে পারেন- ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এসেছে কবির কবিতা থেকে; তিনিই বলতে পারেন- রাজনীতি করতে হলে লেখাপড়া করতে হবে, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে হবে।

জীবনভর আমরা অবলম্বন খুঁজি, বেঁচে থাকার অবলম্বন। অকূল পাথারে একটু খরকুটো পেলেও যেনো বেঁচে বর্তে যায় জীবন! সাহিত্যকথনের এমন মেটাফোর যে সবে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা এক তরুণের জীবনবাস্তবতা হয়ে দেখা দেবে তা কে ভেবেছিল? কিন্তু অদৃষ্ট কখনো কখনো মানুষের দৃষ্টি খুলে দেয়। দেখা আলোর অদেখা রূপ শুধু তখনই দেখা যায়। আমি প্রথমবার তা প্রকটভাবে অনুভব করেছি- ২০১৩ সালের ডিসেম্বর ও ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসজুড়ে। তুমুল অস্বস্তির সেই সময়জুড়ে আমরা তাকিয়ে ছিলাম একজন নারীর দিকে, প্রাত্যহিক অনিশ্চিত সময়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের বাঁচার স্বপ্ন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পরিচিত অনেক মুখের আনাগোণা কমে যেতে দেখেছি। কী এক দুঃসময়, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন মিছিলের ভিড় যেনো হুট করেই হালকা হয়ে গেলো। অধিকাংশই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরের কিছু দিনের দৃশ্য এমনই ছিল। অল্প কিছু মানুষই হয়তো দৃঢ় চিত্তে অপেক্ষা করছিলেন একজন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য।

সেসব আগুন দিনের কথা। এই স্মৃতি কখনো রোমন্থন করতে চাইনি। ঘুম কেড়ে নেওয়া সেই রাতগুলো এখনও স্বস্তি কেড়ে নেয়। কীসব ভয়াবহ সময়ের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন জীবন হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া আর রাতের রাস্তায় দুরু দুরু বুকে ফের ঘরে ফেরা। সন্ধ্যার সোডিয়াম আলোয় শাহবাগ-মৎসভবন এলাকার তীব্র জ্যামের বদলে সুনশান সড়ক দেখেছি, চোখের সামনে চলন্ত বাসকে জ্বলে যেতে দেখেছি, তার পাশ দিয়েই অন্য ড্রাইভারকে যাত্রীভরা বাস নিয়ে সাঁই করে প্রাণভয়ে ছুটতে দেখেছি, সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরার তাড়া আর মৃত্যুভয়ে পড়ন্ত বিকালের রাস্তাজুড়ে মানুষের ভয়ার্ত চাহনি দেখেছি, কোলাহলমুখর এই তিলোত্তমা নগরী হুট করেই যেনো হয়ে গেলো মৃত্যুপুরী। রাত করে ঘরে ফেরার পথে মোহাম্মদপুরের রাস্তায় উপর্যুপুরি এলাপাথারি ককটেল ফোটানো দেখে জান নিয়ে দৌড়েছি। এক পর্যায়ে শেষ রাতে ক্লান্তির ঘুমের মধ্যেও আতঙ্কে জেগে ওঠা, প্রতিদিন সকালের পত্রিকাজুড়ে পেট্রোল বোমায় ঝলসানো লাশের ছবি আর আহাজারির সংবাদ পাঠ করা আমার নিত্য রুটিন হয়ে গিয়েছিল। দেশজুড়ে চলমান এমন নারকীয় আগুন-সন্ত্রাস কখনো কল্পনাতেও ছিল না। কোনো দেশের সাধারণ নাগরিকদের চলার পথে, বাড়িতে, তাদের বহনকারী যানবাহনে এভাবে আচমকা পেট্রোল বোমা ছুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর ইতিহাস আগে জানা ছিল না। সেগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এখনও বেঁচে আছি ভেবে প্রতিদিন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছি। অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মরদেহ হয়ে কীভাবে যে দিনগুলো কাটিয়েছি, এখনও চমকে উঠি। কী এক আতঙ্কময় সময়, কলম থেমে গিয়েছিল, কীবোর্ড চেপেও কবিতা আসেনি। এমন দুর্যোগের ঘনঘাটায় যিনি তার মায়ার আঁচল মেলে ধরে শীতল ছায়ার স্বস্তি দিতে চাইলেন- তিনিই শেখ হাসিনা। আমি তাকে ভালোবেসে নেত্রী বলি। আমি তার মাথার ওপর অদৃশ্য শিরস্ত্রাণ দেখি।

যাই হোক, সেই লেলিহান আগুনের দিনগুলি সহ্যসীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিলো যখন, সাধারণ মানুষ আর পারছিল না নিতে, নরক হয়ে উঠেছিল দেশটা। তখনই চূড়ান্তভাবে রাশ টানলেন নেত্রী। এককভাবে স্ফিংস হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি যেনো গোধূলির পরে একাকী সন্ধ্যা তারা, তবু আগুনে পোড়া তামার মতো বলিষ্ঠ হয়ে উঠলো তার মায়াভরা মুখটা। যেকোনো মূল্যে সন্ত্রাস প্রতিহতের ঘোষণা দিলেন। রাজনীতির গণ্ডির অনেক বাইরে বিএনপি-জামায়াতের এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে অবস্থান নিতে আদেশ দিলেন, সাহস জোগালেন। দলীয় নেতাকর্মীদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেন অতীতের ত্যাগের কথা, ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা।মন্ত্রের মতো কাজ হলো। একেকটা দিনে তার একেকটি পদক্ষেপ, সবকিছুর মধ্যেই যেনো নতুনত্ব। শেখ হাসিনার শৌর্যের কাছে অগ্নিসন্ত্রাস মাথানত করলো। এরপর নতুন করে ডিজিটাল রূপে সাজতে শুরু করলো সোনার বাংলার জগত সংসার।

দিশেহারা পাখিরা আবার ফিরলো নীড়ে। প্রিয় নেত্রী, আগুনের স্মৃতি ফিকে হয়ে আসে তোমার মুখের দিকে চেয়ে।

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, জাতীয় কবিতা পরিষদ