শেখ হাসিনার মুক্তি ও গণতন্ত্রের বিজয়

জুন ১৩, ২০২২

ড. প্রণব কুমার পান্ডে  :  বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি রাজনীতির বিভিন্ন উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছে। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের কাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন ছিল “সোনার বাংলা” প্রতিষ্ঠা করা। সেই “সোনার বাংলা” প্রতিষ্ঠার জন্য যে সমস্থ কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন ছিল, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু সেগুলো গ্রহণ করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ঘাতকের দল মাত্র সাড়ে তিন বছর পরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিহত করেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী সরকার পদত্যাগ করলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসকের নিষ্পেষণে আওয়ামী লীগ যখন ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল, ঠিক তখন ১৯৮১ সালের ১৭মে বাংলাদেশে ফিরে এসে দ্বিধা বিভক্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তারপর থেকে তিনি শুধু দলকেই সুসংগঠিত করেননি, বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হলেও, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন “সোনার বাংলা” প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফলে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হয়। বিএনপি ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করবার অভিপ্রায়ে বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধি করে দেশে এক অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে। ফলে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের সেনা বাহিনী সমর্থিত এক ভিন্নধর্মী সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে।

ক্ষমতা দখল করেই সেই সরকার বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। তাদের সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যাকে কারারুদ্ধ করা হয়। তাঁকে কারারুদ্ধ করবার পরে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে সেই সরকার। তারা দলের মধ্যে একটি শ্রেণীকে সংস্কারপন্থী হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যার দৃঢ় মানসিকতার কাছে তারা হেরে যায় এবং এক সময় তারা উপলব্ধি করে যে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া থেকে তারা যদি সরে না আসে তাহলে জনগণ তাদের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই ২০০৮ সালের ১১ই জুন শেখ হাসিনাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা।

কারান্তরীণ থেকে মুক্ত হবার পরে শেখ হাসিনা সেদিন বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি দলকে যেমন পুনরায় সুসংগঠিত করেন, ঠিক তেমনি ভাবে তৎকালীন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করার প্রক্রিয়া ব্যাপারে অবহিত করেন যাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তৎকালীন সরকার বাধ্য হয়েই ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

www.bahannonews.com
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে কিভাবে দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়া যায়-সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন শেখ হাসিনা। সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ১৩ বছরে বাংলাদেশে তাঁর নেতৃত্বে যে উন্নয়ন হয়েছে তা পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত হয়েছে। যারা এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল, আজ তারাই বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী এশিয়ান টাইগার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।

সে দিন যদি শেখ হাসিনা কারামুক্ত না হতে পারতেন, তবে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য ভাবে রচিত হতো। তিনি শুধুমাত্র আওয়ামীলীগকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন নি, বরং দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর আপোষহীন নেতৃত্বের কারণে সেনা বাহিনী সমর্থিত তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কূটচাল থেকে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধু যেমন তাঁর জীবদ্দশায় বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের জীবনের সকল সুখ ও স্বাচ্ছন্দ জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ভাবে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সেই সরকারের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

তিনি সেদিন যেমন তৎকালীন সরকারের কাছে মাথা নত করেননি, এখনও তিনি কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করেন না। যেমনটি তিনি করেছিলেন না বিশ্বব্যাংকের কাছে যখন তারা কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন তাঁর বাবা যেমন কখনোই কারো কাছে মাথা নত করেননি, তিনিও কোনো বিদেশী শক্তির কাছে মাথা নত করবেন না। ফলে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের আজ এই অভূতপূর্ব উন্নয়ন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো সেতু তৈরি হয়েছে দেশে যা আমাদের দেশকে আরো বেশি আত্মমর্যাদাশীল করেছে। একইসাথে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে এই ধরনের সেতু নির্মাণের ফলে দেশের সক্ষমতার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে।

ফলে শেখ হাসিনাকে গণতন্ত্রের মানস কন্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতেই পারে। তাঁর চিন্তা এবং চেতনায় রয়েছে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর বিষয়টি। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনি সবসময় চেয়েছেন বাংলাদেশ যেন একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ফলে ১১ই জুনকে শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবসের সাথে সাথে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। সেদিন তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন জন্যই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা পুনরায় শুরু হয়েছিল। তিনি যদি তৎকালীন সরকারের প্রস্তাবে রাজী হয়ে তাদের সাথে আপস করতেন, তাহলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা যাত্রা শুরু হতো না ২০০৯ সালে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর