আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে ২০২৩ সালের পাঠ্যবই ছাপার আয়োজন

এপ্রিল ২৪, ২০২২

মন্ত্রণালয়ের শর্ত ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে ২০২৩ সালের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এতে আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপাতে সরকারের প্রায় সাড়ে তিনশ’কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হবে। বড় অংকের লেনদেনের মাধ্যমে এমনিটি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

একটি ‘সিন্ডিকেট’কে বই ছাপার সুযোগ করে দেওয়ার এই প্রস্তুতি নেওয়ার কারণে মেসার্স জ্ঞান বিচিত্রা প্রেস পাবলিকেশনসের প্রোপাইটার মো. জিয়াউল হক আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সচিব, এনসিটিবির রুটিন দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান, এনসিটিবির সচিব এবং অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক), বিতরণ নিয়ন্ত্রক, উৎপাদন নিয়ন্ত্রককে এ নোটিশ পাঠানো হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে নতুন একটি শর্ত যোগ করে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। শর্তে বলা ছিল, আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ওয়েব প্রিন্টিং মেশিনের সক্ষমতা বেশি থাকলে তাদের বেশি কাজ দিতে হবে।
জানা গেছে,২০২৩ সালের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা কাজের দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে সম্প্রতি একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।ওই বৈঠকে পুরনো মেশিনের মূদ্রণ মালিকদের কাজ দিতে আগের শর্তটি তুলে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়।

বিষয়টি জানাজানি হলে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন মূদ্রণ মাীরকদের পক্ষে মেসার্স জ্ঞান বিচিত্রা প্রেস পাবলিকেশনসের প্রোপাইটার মো. জিয়াউল হক আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান।

লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়, চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে রুটিন দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান স্বার্থন্বেষী মহলের প্ররোচনায় হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে শর্ত ছাড়া দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে। এতে সরকারের বিশাল অঙ্কের অর্থ ক্ষতি হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, একই সক্ষতাসম্পন্ন প্রিন্টিং মেশিন হলে পুরনো মেশিনে ছাপার মান খারাপ হতে বাধ্য। তাছাড়া পুরনো মেশিনে বই ছাপার ক্ষেত্রে নতুন মেশিনের চেয়ে দেরি হবে। অন্যদিকে নতুন মেশিন পরিচালনায় অপেক্ষাকৃত কম শ্রমিক প্রয়োজন হয়। এ কারণে নতুন মেশিনে পরিচালিত মূদ্রণ প্রতিষ্ঠান কম রেটে দরপত্র দাখিল করতে পারবে। আর কম সময়ের মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করতে পারবে।
এতো কিছুর পরও, এই শর্ত উঠিয়ে দিতে এনসিটিবিকে ম্যানেজ করেছে ব্যবসায়ীদের পুরনো একটি ‘সিন্ডিকেট’। গত বছর যে ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে দিয়ে পুনঃদরপত্র আহ্বান করেছিল এনসিটিবি।

মেসার্স জ্ঞান বিচিত্রা প্রেস পাবলিকেশনসের প্রোপাইটার মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘বড় ধরনের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দরপত্রের শর্ত তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও আদালতের আইন অমান্য করে এ কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

এনসিটিবি সংশ্লিষ্ট ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, রুটিন দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যানের শর্ত তুলে দেওয়ার এখতিয়ার নেই। তিনি শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন।

তবে এনসিটিবির রুটিন দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেছেন, ‘যা করা হবে, বিশেষজ্ঞদের মত নিয়েই করা হবে। আগামী মাসে দরপত্র আহ্বান করা হবে। এ বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’

শর্ত উঠিয়ে পুরনো মেশিনে পরিচালিত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে এবার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ‘২০১০ সাল থেকে এটা হয়ে আসছে। গত বছর শুধু প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করে শর্ক যুক্ত করা হয়েছে। আমরা বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে দরপত্র আহ্বান করবো। নতুন পুরনো যাই হোক মেশিনের ক্যাপাসিটি এক থাকলে দিতে পারবো না তা নয়, দিতেও পারি।’

আদালতের নির্দেশনার বিষয়ে অধ্যাপক মশিউজ্জামান গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, ‘আদালতের রায়ে বলেনি পুরাতন মেশিন পরিচালিত মূদ্রণ মালিকদের দেওয়া যাবে না।’

এনসিটিবি ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২০ মে’র দরপত্রের নির্ধারিত শর্ত বাতিল চেয়ে পুরাতন মেশিন পরিচালিত মূদ্রণ প্রতিষ্ঠাগুলোর পক্ষে প্রিয়াংকা প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস হাইকোর্টে রিট করে। তবে হাইকোর্ট বিভাগ রিট আবেদনটি খারিজ করেন।
রিটের আদেশে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে একটি কাজে সরকারের ৫৪ কোটি ৪০ লাখ ৩ হাজার ৬১ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। অন্যদিকে, এনসিটিবি’র একটি সূত্র জানায়, চারটি কাজে গত বছর প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।

গত বছর শর্ত যুক্ত করে জনগণের অর্থ সাশ্রয় করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের প্রসংসা করা হয়েছে আদালতের নির্দেশনায়। তার পরও আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষ করে রুটিন দায়িত্বপালন করা চেয়ারম্যান দরপত্রের শর্ত তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপতে ২০২১ সালে আহ্বান করা দরপত্রে ‘সিন্ডিকেট’ করে অতিরিক্ত দর নির্ধারণ করে এক শ্রেণির মূদ্রণ প্রতিষ্ঠান। বাধ্য হয়ে পুনঃদরপত্র আহ্বান করেছিল এনসিটিবি।

এদিকে রুটিন দায়িত্বে আসার পর এনসিটিবির চেয়ারম্যান রাজধানীতে ফ্লাট কেনার ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা আলোচনা করছেন। তবে এই ফ্লাটের অনুসন্ধান করা সময় সাপেক্ষ হওয়ায় এর সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।