নারী আরাধ্য, নারীই শিকার

এপ্রিল ২৩, ২০১৩

0,,16762645_402,00ঢাকা জার্নাল: এ এক অদ্ভুত আঁধারের দেশে বাস করি আমরা, যে দেশে নারীশক্তি পূজিত হয়, আবার নারীরাই হয়ে ওঠে আক্রমণের লক্ষ্য, লাঞ্ছনা আর নিগ্রহের শিকার৷ নবীন পরিচালিকা কঙ্কনা চক্রবর্তী সেই বৈপরীত্যের কথাই বললেন তাঁর তথ্যচিত্রে৷

২০১২ সালের ৯ জুলাই এক লজ্জাজনক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য অসমের গুয়াহাটি শহরে৷ জনবহুল এলাকায় এক তরুণীর শারীরিক নিগ্রহ এবং শ্লীলতাহানি করেছিল একদল লোক৷ পথচলতি বহু লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে সেই হেনস্থা দেখেছিল, কিন্তু কেউ নিগ্রহকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি বা পুলিশে খবর দেয়নি৷

তীব্র সমালোচিত হওয়াএই ঘটনাই কঙ্কনা চক্রবর্তীকে তাড়িত করেছিল, তার নিজের দেশে মহিলাদের অবস্থান নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করতে, যার নাম কঙ্কনা দিয়েছেন ‘Women Prayed and Preyed upon’ – যে নারী পুজো পান, সেই নারীই হয়ে ওঠেন বধ্য৷

ভারতীয় সমাজের এই নির্মম বৈপরীত্য, এই জটিল স্ববিরোধিতাকে ধরতে চেষ্টা করেছেন কঙ্কনা, তাঁর তথ্যচিত্রে৷ নির্জলা, অনুর্বর মরুভূমির রাজ্য রাজস্থানে এমন একটি গ্রাম আছে, যেখানে কোনো পরিবারে মেয়ে জন্মালে ১১১টি চারাগাছ রোপন করে সেই জন্ম উদযাপিত হয়৷ কারণ, কন্যাসন্তান জীবনের উর্বরাশক্তি আর বহমানতার প্রতীক৷ অথচ সেই একই রাজস্থানে বহু পরিবারে কন্যাসন্তান জন্মালে আঁতুড়েই মেরে ফেলা হয়, যদি না গর্ভস্থ শিশুটিকে মেরে ফেলা যায় তার আগেই৷

তথ্যচিত্রটি চমৎকার শুরু করেছেন কঙ্কনা। দুর্গাপ্রতিমার খড়ের কাঠামো বাঁধার ছবির পাশাপাশি মাতৃগর্ভে ১৮ সপ্তাহ বয়সি একটি কন্যাভ্রুণের বেড়ে ওঠার আলট্রাসোনোগ্রাফ ছবি দেখিয়ে৷ প্রতিমার হাত পায়ের আঙুল তৈরি হয়, মুখ তৈরি হয় আর মাতৃজঠরে কন্যাটিও বেড়ে ওঠে একটু একটু করে৷ একদিন শিশুটি ভূমিষ্ঠও হয়৷ কিন্তু যেহেতু সে মেয়ে, যেহেতু সে অবাঞ্ছিত, তাকে নামিয়ে দিয়ে আসা হয় রেললাইনের ধারে৷ এবং কী নির্মম কৌতুক, পরের দৃশ্যেই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মহাসমারোহে পুজো হয় দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমার, যে দেবীমূর্তি আসলে নারীশক্তির প্রতীক৷

কঙ্কনার তথ্যচিত্রে বার বার ফিরে এসেছে নারী আরাধনার এই দৃশ্যকল্পগুলো৷ একদিকে কুমারী পুজা চলে দারুণ ভক্তিভরে, অন্যদিকে উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী মেয়েটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় একদল পুরুষের সামনে৷ কারা সেই পুরুষেরা? হতে পারে যৌনপল্লীতে নারীদেহের সওদা করতে আসা সম্ভাব্য খদ্দের৷ আবার এমনও হতে পারে, তারা আমার আপনার বাড়িতে বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখতে আসা হবু সম্বন্ধীরা, যারা প্রশ্ন করে, গান গাইতে এবং হেঁটে দেখাতে বলে, বাজিয়ে দেখে নেন নারী-পণ্যটিকে বলেন কঙ্কনা।

গেরস্ত সন্ত্রাস বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কথাও এসেছে কঙ্কনার ছবিতে, যা কোথাও কোথাও হয়ে উঠেছে তথ্য ও নাটকীয় দৃশ্যরচনার মিশেল৷ আধ ঘণ্টার এই ছবিকে তাই ডকু-ড্রামা বলছেন মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করা, নিউ ইয়র্ক ফিল্ম অ্যাকাডেমি থেকে অভিনয়ের পাঠ নিয়ে আসা ২৩ বছরের কঙ্কনা৷ তবে দাম্পত্যজীবনে নির্যাতন, বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নেশা করে হুল্লোড় করতে গিয়ে শ্লীলতাহানি হওয়ার মতো ঘটনা তুলে ধরতে কল্পিত দৃশ্য রচনা করতে হলেও কঙ্কনার ডকু-ড্রামার বাকি চরিত্রেরা উঠে এসেছে রূঢ় বাস্তব থেকে৷

আছেন বারাসতের রিঙ্কু দাস, মদ্যপ গুন্ডাদের হাত থেকে যাঁর ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল ভাই রাজীব দাসকে৷ কঙ্কনার ছবিতে রিঙ্কুর বক্তব্য বুঝিয়ে দিল, মেয়েদের লাঞ্ছনার আসলে কোনো শেষ নেই৷ রিঙ্কুর চোখের সামনে তাঁর ভাইকে খুন করেছিল গুন্ডারা৷ কিন্তু দুবছর পরেও সেই মামলার বিচার শেষ হয়নি, কারও শাস্তি হয়নি৷

এভাবেই কঙ্কনার তথ্যচিত্রে উঠে এসেছেন অ্যাসিড হামলার শিকার এক মহিলা আর তাঁর অসহায় বাবার কথা৷ ছবির পর্দায় তাঁর পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখ আর নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখ দেখে শিউরে উঠেছেন দর্শকরা৷

ছবির শেষে কঙ্কনার ডাকে তাঁরাই যখন দর্শক আসন থেকে উঠে গিয়েছেন মঞ্চে, দর্শকরা সমবেত করতালিতে তারিফ করেছেন বাবা আর মেয়ের সাহসিকতা আর লড়াইয়ের৷ হ্যাঁ, ৩০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে হতাশা নয়, বরং আশার কথাই কঙ্কনা বলেছেন৷ তাই ছবিতে এসেছে কলকাতার সোনাগাছির দুর্বার মহিলা সমিতির কথা, যাদের হাত ধরে বহু মেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন৷ এসেছে জলন্ধরের এক প্রবীণ শিখ দম্পতির কথা, যাঁরা পরিত্যক্ত কন্যাশিশুদের জন্যে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন৷

আর ছবির একেবারে শুরুতে যে সদ্যোজাত শিশুকন্যা পরিত্যক্ত হয়েছিল রেললাইনের ধারে, তাকে বুকে তুলে নেয় একজোড়া স্নেহশীল হাত৷

আর গোটা তথ্যচিত্র জুড়েই প্রায় মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয় একটা কথা, নো ওম্যান নো লাইফ৷ নারীদের ছাড়া জীবন অর্থহীন৷ সমাজের প্রতি এক নবীন পরিচালিকার বার্তা এটাই৷

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.