শেখ হাসিনার জন্মদিনের গল্প

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১

বাবা ছিলেন দেশের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রপতিও। তবু সাড়ম্বরে সন্তানদের জন্মদিন পালন করা হতো না ঐতিহাসিক ওই বাড়িতে। সন্তানদের জন্মদিনে কেক কাটা হতো সাদামাটাভাবেই, মিলতো না কোনও উপহার। তবে বাড়তি আয়োজনের মধ্যে থাকতো একটু ‘ভালো রান্না’। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব দম্পতির সন্তানদের জন্মদিনগুলো এভাবেই পালিত হতো।

বড় কেক কাটা, আত্মীয়-স্বজন নিমন্ত্রণ করে ভূরিভোজ করা—এমন সাড়ম্বর আয়োজন কখনও হয়নি বঙ্গবন্ধুকন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনকে ঘিরে। বাবার পরিবারে তার জন্মদিন যেমন সাদামাটা ছিল, তেমনই বিয়ের পরে স্বামীর ঘরেও সাদামাটাভাবেই কেটেছে তার জন্মদিন।

প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনের আয়োজন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তারই খালাতো ভাই শেখ শহীদুল ইসলাম এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনার জন্মদিনে কেমন থাকতো ওই বাড়ির পরিবেশ, কিংবা বিয়ের পর স্বামীর বাসায় কেমন কাটতো তার জন্মদিন, সে বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন শেখ শহীদুল ইসলাম।

অবশ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা হয়েও বড় কেক কেটে সাড়ম্বরে জন্মদিন পালনের কোনও নজির নেই শেখ হাসিনার ৭৪ বছর বয়সে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

বর্তমানে জাতীয় পার্টি-জেপি’র মহাসচিব শেখ শহীদুল বলেন, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বড় মেয়ে হাসিনা আপা। কিন্তু কখনও ওই বাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে হাসিনা আপার জন্মদিন পালন করতে আমি দেখিনি। অন্য দিনগুলের মতোই সাধারণভাবেই কেটে যেত তার জন্মদিনটি। রাষ্ট্রপতির মেয়ে তাই সাড়ম্বরে বড় কেক কেটে জন্মদিন পালনের মানসিকতা ওই পরিবারের কোনও সদস্যের ছিল না।

শেখ শহীদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু পরিবারে হাসিনা আপা নিজেও এই মানসিকতায় বেড়ে ওঠেননি। তার শৈশব, কৈশোর ও বৈবাহিক জীবনেও জন্মদিন পালিত হয়েছে সাদামাটা। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এভাবেই জন্মদিন পালন হতো শেখ হাসিনার।’

১৬ বছর ছিল না জন্মদিনের কোনও আয়োজন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছরের প্রবাস জীবনে সাদামাটাভাবেও জন্মদিন পালন করা হয়নি শেখ হাসিনার। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এভাবেই কোনও আয়োজন ছাড়াই কেটেছে তার জন্মদিন। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে এতিম দুই বোনের সাধারণ জীবনযাপনও তখন কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।

৫০০ টাকা উপহার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু
শেখ হাসিনার জন্মদিনের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বয়সে এক বছরের ছোট খালাতো ভাই শেখ শহীদ বলেন, ‘১৯৬৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর হাসিনা আপার জন্মদিনের একটি ঘটনা স্পষ্ট স্মৃতিতে রয়েছে। ওই জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকালে ঘুম থেকে উঠে ৫০০ টাকা তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনার হাতে দিয়ে বলেছিলেন—‘এটা দিলাম জন্মদিন উপলক্ষে উপহার। তোর মতো করে খরচ করে নিস। অন্য জন্মদিনগুলোতে একটু-আধটু উপহার দিতেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু কেক কাটা, বিরাট অনুষ্ঠান করা—জন্মদিনে এ ধরনের কোনও কিছু বঙ্গবন্ধুর বাসায় হতো না।’

ছাত্রজীবনে প্রায় ১০ বছর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে কাটানো শেখ শহীদ বলেন, ‘আমাদের বাসায় ওইভাবে সাড়ম্বরে জন্মদিন পালন হতো না। বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিনও সাড়ম্বরে পালন করতেন না। পরিবারের সদস্যদেরও জন্মদিন সাড়ম্বরে পালন করা হতো, তবে ওইদিন একটু ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন থাকতো। সেটা বেগম মুজিব নিজেই তত্ত্বাবধান করতেন। ওই দিন সবাই মিলে একসঙ্গে খেতাম। তবে পরিবারের বাইরের কেউ থাকতো না। এভাবেই সাধারণভাবে জন্মদিন কেটে যেত।’

ভূরিভোজ হতো না
তিনি জানান, হাসিনা আপার জন্মদিনে ভাইবোনেরা মিলে উইশ করতাম। সবাই মিলে আনন্দ করতাম। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, মেহমান ডেকে ভূরিভোজের কোনও আয়োজন হতো না। তবে জন্মদিন মনে করে বাসায় কেউ এলে তারা খাওয়া-দাওয়ায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন, এটুকুই ছিল জন্মদিন।

শেখ শহীদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যেই বলতেন—দেশের মানুষের জীবনের কোনও মূল্য নেই, যে দেশের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, একবেলা একমুঠো খেতে পায় না, সেই দেশে ঘটা করে জন্মদিন পালনের কি কোনও সার্থকতা আছে? এটা উনি নিজের ক্ষেত্রে বলেন।’

শেখ হাসিনার খালাতো ভাই শেখ শহীদ আরও বলেন, ‘১৯৬৮ সালে হাসিনা আপার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় আমরা কেউ উপস্থিত থাকতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন।

বিয়ের পরের জন্মদিন
শেখ হাসিনার বিয়ের পরের বছরের জন্মদিনের স্মৃতিচারণ করে শহীদ বলেন, ‘ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে একটা জন্মদিনে ১৯৬৯ সালে হাসিনা আপা ৩২ নম্বরের অদূরে স্বামীর ৬৮০ নম্বরের দোতলা বাসায় ছিলেন। আমরা জন্মদিনে ওই বাসায় যাই। ওই বাসায় ওয়াজেদ সাহেব খাবারের আয়োজন করেন। পরিবারের ভাইবোনেরা সবাই মিলে হাসিনা আপাকে উইশ করি। সবাই মিলে হৈ- হুল্লোড় করে চলে আসি।’

জন্মদিন কখনও সাড়ম্বরে হতো না
এদিকে শেখ হাসিনার আত্মীয় এবং দীর্ঘদিন তার সান্নিধ্যে কাটানো নজিব আহমেদও শেখ হাসিনার সাদামাটা জন্মদিন পালনের কথা জানান। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে খুব কাছ থেকে দেখছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন সম্পর্কে জানতে চাইলে নজিব আহমেদ বলেন, ‘কখনও সাড়ম্বরে জন্মোৎসব করার আগ্রহ শেখ হাসিনার মধ্যে দেখিনি। ওই দিনটিতে পরিবারে একটু ভালো কিছু রান্না, রেহানা আপা দেশে থাকলে তিনি একটি ছোট কেক এনে স্বল্প পরিসরে কাটা ও সামান্য কিছু মিষ্টিমুখেই সীমাবদ্ধ থাকতো জন্মদিন।’

৯১ থেকে শুরু হয় নেতাকর্মীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়
শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ওই বছরও পারিবারিকভাবেই কেটেছে তার জন্মদিন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জন্মদিনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ও হতো না। ১৯৯১-১৯৯২ সালের দিকে শেখ হাসিনা তার জন্মদিনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু করেন।

নজিব আহমেদ বলেন, ‘কখনও কোনও আনুষ্ঠানিক বা সাড়ম্বরে আওয়ামী লীগ সভাপতির জন্মদিন পালন করা হতো না। ১৯৮১ সালে মে মাসে যখন উনি দেশে ফিরে আসেন, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে আমার পথচলা শুরু। পুরোটা সময় উনাকে আমি দেখেছি—অতি সাধারণ জীবনযাপন করেন। জন্মদিনটাও অন্য সাধারণ দিনের মতোই কাটে। তবে ছোট আপা (শেখ রেহানা) অথবা ওনার দুই সন্তান জয় ও পুতুল সঙ্গে থাকলে ছোট একটি কেক কাটা হয়, একেবারেই পারিবারিক আয়োজনে। ওইদিন বাসায় কিছুটা ভালো খাবারের আয়োজন থাকে। রাতে খাবার টেবিলে মিষ্টি জাতীয় কোনও খাবার একে-অপরকে খাইয়ে দেওয়া—এটাই শেখ হাসিনার জন্মদিনের আয়োজন।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেটাও হতো না বলে তিনি জানান। ১৯৯১ সালের পরের জন্মদিনের বর্ণনা দিয়ে নজিব বলেন, দলীয় নেতাকর্মীরা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে কখনও তৎকালীন মহাখালীর বাসায় আসতেন। ওনার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। তারা ফুল নিয়ে আসতেন, এটা দেখেছি।

তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটা করে জন্মদিন উদযাপন পছন্দ করেন না। জন্মদিনেও তিনি অন্য দিনগুলোর মতো রুটিন কাজেই ব্যস্ত থাকেন।

নজিবের স্মৃতিতে শেখ হাসিনার একটি জন্মদিন
নজিব আহমদ বলেন, ‘৯০ দশকের দিকে কোনও একটা জন্মদিনে আমি দেখেছি, দুলাভাই (পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ওয়াজেদ মিয়া) অফিস থেকে একটু আগে এসে ওনার স্ত্রী শেখ হাসিনা, সন্তান জয় ও পুতুলকে নিয়ে ঢাকায় কোনও একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যান। সবাই মিলে ঘুরেফিরে বাইরে খেয়ে বাসায় আসেন। এছাড়া ওয়াজেদ মিয়া বেঁচে থাকতে আপার জন্মদিন এলে আমাদের ডেকে কিছু টাকা দিয়ে ভালো বাজার-সদাই এনে খাওয়ার আয়োজন করতে বলতেন। ওই আয়োজনে বাইরের কেউই থাকতো না। ঘরোয়াভাবে, ঘরের মানুষ নিয়ে একত্রে খাওয়া-দাওয়া হতো।’

২০০১ সালের পর শেখ হাসিনার জন্মদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ তিনি যখন বিরোধী দলের নেতা, তখন জন্মদিন এলে দলীয় নেতাকর্মীরা সুধা সদনে আসতেন। সকাল ৮-৯টার দিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ওপরের তলার রুম থেকে নিচে নেমে আসতেন। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে কখনও কখনও মিষ্টিমুখ করাতেন নেতাকর্মীদের। এই ছিল জন্মদিনের উৎসব।’

জন্মদিনে এতিমদের জন্য ফল ও মিষ্টি
শেখ হাসিনা উপহার দেওয়া-নেওয়া মোটেও পছন্দ করেন না। তবু জন্মদিনে কোথাও থেকে ফল বা মিষ্টি– এমন কিছু উপহার এলে সামান্য কিছু নিজের জন্য রেখে, বাকিটা সোবহানবাগ মসজিদের এতিমখানায় শিশুদের দিয়ে দিতে বলতেন, যোগ করেন নজিব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা সোবহানবাগ মসজিদে মিলাদ দিতাম, এতিমখানায় খাবার পাঠাতাম।’

এছাড়া রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় শেখ হাসিনা জন্মদিনে অনেক সময় দেশের বাইরে থেকেছেন। এই সময়টাতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় থাকেন, এবারও আছেন। অধিকাংশ সময় বিশেষ এই দিনটিতে তাকে বিমানে থাকতে হয়। সৌজন্য:বাংলা ট্রিবিউন