পীর সাহেব ভাবতে শিখুন || রঞ্জনা বিশ্বাস

আগস্ট ৬, ২০২১

আচ্ছা উচ্চাভিলাষ কি পুরুষের একচেটিয়া? নারীরা কি একা নষ্ট হতে পারে? আর নষ্ট বলছেন কাকে? ঘুষ খাওয়া পুরুষ নষ্ট নয়? সরকারি সম্পদ লুট করা পুরুষ নষ্ট নয়? স্ত্রী থাকা সত্বেও মডেল নারীদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো পুরুষ নষ্ট নয়? ইয়াবা মাদকের অবৈধ ব্যবসা করে যে রাজনীতিক সে নষ্ট নয়? নষ্ট বলতে কেবল যৌনাঙ্গের অপবিত্রতাকে বুঝালে সেটা উভয়ের দিক থেকেই বোঝাতে হবে। আর যৌনতাকে চরিত্রের অনুষঙ্গ মনে করার যুগ কী এটা? যে যৌনতাকে ট্যাবু করবে সে এঞ্জেল, আর যে এই ট্যাবু ভাঙবে সে চরিত্রহীন এই ফতোয়া দেওয়া বন্ধ করা উচিত। যে ট্যাবু করতে চায় করুক, যে করতে চায় না সে করবে না! তাতে কার কী বলার থাকতে পার? পরীমনি আটক হয়েছেন বলেই তিনি চরিত্রহীন আর নাসির, আনভীরেরা এমন কী আপনি চরিত্রবাণ এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের যুগে সমাজের শুদ্ধতা অশুদ্ধতা মাপার কোনো পরিমাপক আমার জানা নেই। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের জগতে মানুষ তার প্রয়োজন মতো যা কিছু তা এডাপ্ট করে, এই এডাপটেশন নানাভাবে হয়। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার লড়াইয়ে ‘বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক খপ্পর’ এক বিশাল বিস্ময়।  এই বিস্ময়কে বিস্ময়করভাবে উপস্থাপন করছে বাণিজ্যের নায়করা।

গোয়ালিনী দুধের বিজ্ঞাপনে গরুর দুধকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ছুটে আসা মেয়ের বিশেষ দেহাংশকে। শুধু তাই নয়, বিয়ে থেকে চাকুরি সব কিছুতেই ফর্সা হতে হবে। কালো মেয়ের চাকুরী ভাগ্য খারাপ। বিজ্ঞাপনে এসব কীসের আলামত? রেসিজমকে উস্কে দিয়ে কি সমাজকে কলুষিত করছেন না তারা?

বিজ্ঞাপনে নারীকে দেখানো হচ্ছে লোভী হিসেবে। বিশেষ ব্র্যান্ডের ফ্রিজ না পেলে সংসার করবে না সে। আবার পারফিউমের ঘ্রাণে মাতোয়ারা নারী পুরাতন প্রেমিক ছেড়ে ছুটছেন অন্য পুরুষের দিকে। কী বার্তা যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে এর মাধ্যমে? ভেবেছেন কখনও? আরো কথা আছে—‘….একটু চাপ দাও, আসল মজা নাও…. আসল মজা ভিতরে’। আচ্ছা,  এই দ্ব্যার্থবোধক স্লোগান  ও জিঙ্গেল  কী ধরনের প্রভাব ফেলছে সমাজে? কিংবা, ‘তৃষ্ণায় দুহাত বাড়ালে তোমায় পাওয়া যায়’, এই বিজ্ঞাপনে কোমল পানীয় হাতে যে পুরুষটি অভিনয় করছে সে একইসঙ্গে তার চারপাশে নাচতে থাকা নারীর দিকে হাত বাড়ালেন? এটি কি নারীর পণ্যায়ণের একটি বাস্তব উদাহরণ নয়। পুরুষের তৃষ্ণা কেবল যে তার গলায় থাকে না সেটি সে সমাজকে জানিয়ে দিচ্ছে বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে। আর তৈরি করছে তার তৃষ্ণা মিটানোর উপাদান ‘নারী’।  এই বিজ্ঞাপন দেখে যদি আজকের কোনো শিশু নিজেকে নৃত্যরতা নারী হয়ে উঠতে চায় কিংবা কোমলপানীয় হাতে থাকা পুরুষটিকে স্বপ্নপুরুষ মনে করতে শেখে তাতে দোষটা ওই মেয়েটার হবে কেন? ভাবুন পীর সাহেব ভাবতে শিখুন।  মিডিয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূল পণ্যকে ছাড়িয়ে  নারীকে অবজেক্টিফাই করে যে বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে এটা কারা করছে??

একসময় নারী পুরুষের সঙ্গী নির্বাচনে নারীর ভুমিকা ছিল মুখ্য। ভোমেরো নাসার মাধ্যমে কেবল নারী এই সুবিধাটা নিতে পারে সন্তানের টিকে থাকাকে নিরাপদ করতে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের চাপে পিষ্ট সমাজে নারীর শরীর ও যৌনতা এখন ট্যাবু। সেই ট্যাবু ভেঙে যে নারীরা বের হয়ে আসেন তাদের ভয় পায় পুরুষ সমাজ, ফলে শুদ্ধাশুদ্ধের মন্ত্র পড়তে শুরু করেন তারা। আচ্ছা উচ্চাভিলাষ কি পুরুষের একচেটিয়া?  নারী কি একা হতে পারে? আর নষ্ট বলছেন কাকে? ঘুষ খাওয়া পুরুষ নষ্ট নয়, সরকারি সম্পদ লুট করা পুরুষ নষ্ট নয়, স্ত্রী থাকা সত্বেও মডেল নারীদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো পুরুষ নষ্ট নয়, ইয়াবা মাদকের অবৈধ ব্যবসা করে যে রাজনীতিক সে নষ্ট নয়? নষ্ট বলতে কেবল যৌনাঙ্গের অপবিত্রতাকে বুঝালে সেটা উভয়ের দিক থেকেই বোঝাতে হবে। আর যৌনতাকে চরিত্রের অনুষঙ্গ মনে করার যুগ কী এটা? যে যৌনতাকে ট্যাবু করবে সে এঞ্জেল, আর যে এই ট্যাবু ভাঙবে সে চরিত্রহীন এই ফতোয়া দেওয়া বন্ধ করা উচিত।  যে ট্যাবু করতে চায় করুক, যে করতে চায় না সে করবে না! তাতে কার কী বলার থাকতে পার?

পরীমনি আটক হয়েছেন বলেই তিনি চরিত্রহীন আর নাসির, আনভীরেরা এমন কী আপনি চরিত্রবাণ এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

পরীমনি ইস্যুতে কিছু বলতে চাইনি তবু একটা কথা বলতে চাই—পরীমনির বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়েছে? হয়নি।  তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগও নেই তা হলে RAB  কেন  তাকে জঙ্গি ধরার স্টাইলে তাকে ধরল? সে কি সন্ত্রাসী? প্রমাণিত হয়নি। র‌্যাব এর এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অবৈধ অস্ত্র, অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার, সরকারি নির্দেশে যে কোনো অভিযান চালানো,  মাদকব্যবসায়ী সম্পর্কে অভিযোগ গ্রহণ? তাহলে কী দাঁড়ালো?  দাঁড়ায় এই যে, পরীমনির ঘরে মদের বার আছে এই অভিযোগ কেউ করেছে র‌্যাবের কাছে, যার ভিত্তিতে এই অভিযান। তাহলে প্রশ্ন কে করেছে অভিযোগ?  প্রতিহিংসাচরিতার্থকারী নাসির নয় তো? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর বাড়বাড়ন্ত কোনোকালে সহ্য করা হয়নি আজও হবে না।  এবং এই কারণে ‘পরীমনি’ নাটক অভিনীত হলো।  এই সমাজ এমন একটা সমাজ যেখানে পুরুষ তার প্রয়োজনে একজন নারীকে সৃষ্টি করে তারপর তাকে যতক্ষণ করায়ত্তে রাখা যায় ততক্ষণ সে ভালো, না বললে তাকে দেগে দেওয়া হয় চরিহীনের তকমা। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশে এইসব চলে না। সেখানে যৌনতা স্রেফ প্রয়োজন, এটা চরিত্রের অংশ নয়, বিষয়ও নয়।এটা ব্যক্তিত্বের বিষয়। আমি মনে করি পরীমণদের ব্যক্তিত্বর সমস্যা থাকতে পারে কিন্তু সমাজকে কলুষিত করার মতো অপরাধী তারা নন। বরং যারা অভিনেত্রীকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন তারা ঠিক কাজ করেননি। তারা তাকে নোটিশ করতে পারতেন র‌্যাব অফিসে দেখা করার জন্য কিন্তু তারা তা করেননি কারণ তারা পুরুষতান্ত্রিক মনস্তাত্ত্বের ধারক। তাই জঙ্গি ধরার স্টাইলে তাকে ধরে আলোচনায় এসেছেন, মিডিয়া তা লাইভ করেছে। হাস্যকর। বিশ্বের কাছে নিজেদের রুচির পরিচয় তুলে ধরেছেন তারা, বড় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তারা।  পীর সাহেব বলেছেন, এরা বিত্তবানদের ব্লাকমেইল করে অর্থ উপার্জন করে। কী হাস্যকর! অথচ একটা নারীর বিরুদ্ধে এই বিত্তবানরা মামলা করেনি। পণ্যায়ণের যুগে আপনি নারীর দেহকে বিক্রি করবেন কিন্তু দেহের যে মালিক সে কৌশলে আপনাকে ব্যবহার করলেই দোষ?

সময় বদলেছে, দেশিয় সংস্কৃতির পরিবর্তে আপনারাই বিদেশি সংস্কৃতির আমদানি করছেন এখন কেউ যদি দিকথামের হাড়ির বদলে মদের বোতলে ঘর সাজায় তাতে অত দোষ খোঁজার কিছু নেই। যা ন্যায় তা নারী, পুরুষ, ধনী, গরীব সবার বেলায় ন্যয়, যা অন্যায় তা সবার বেলায় অন্যায়। সমাজকে ইতিবাচকভাবে দেশিয় সংস্কৃতির সঙ্গে গতিশীল করুন,  প্রগতিশীলতা আপনা আপনি তৈরি হবে।

রঞ্জনা বিশ্বাস, কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক।

(লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া)