মানুষ কেনো ধর্ষণ করে?

জানুয়ারি ১৪, ২০২১

  • শেখ মনজুরুল ইসলাম

এই প্রশ্নের একটা মৌলিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি অনেক দিন ধরেই। অনেক আর্টিকেল পড়েই বুঝতে পারলাম আসলে এর মৌলিক কোন উত্তর নেই। এর কারণ ও ধরণ বহুমাত্রিক। মানুষ কেনো ধর্ষণ করে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে প্রথমেই যে সকল ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার সিংহ ভাগ হচ্ছে মানুষ কেনো ধর্ষণ হয় তার ব্যাখ্যা। বিগত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন মানুষের মতামতের উপর ভিত্তি করে যে সমস্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সেগুলো মোটামুটি চার ধরণের।
প্রথমত যেটি বেশি প্রচলিত সেটি হচ্ছে মেয়েরা বোরখা পরেনা, হিজাব পরেনা। জামা কাপড়ে সমস্যা।

দ্বিতীয়ত, মেয়েরা একা একা বাসার বাইরে যায়। সন্ধ্যা, রাতে বাইরে থাকার দরকার কী! তৃতীয় কারণ ধর্মীয় ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব।
চতুর্থ, বিচারহীনতা। যারা ধর্ষক তাদের বিচার হতে বিলম্ব হয়, অনেকে ক্ষমতার জোড়ে বের হয়ে আসে।

প্রথম ও দ্বিতীয় কারণে সরাসরি ভিক্টিমকে দোষারোপ করা হয়েছে এবং যারা এই ধারণা পোষণ করে তাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। বোরখা পরা, হিজাব পরা অনেক মেয়েই ধর্ষিত হয়েছে। আবার শুধু বাইরে বের হলেই যে ধর্ষণ হতে হচ্ছে তা না। ঘরের মধ্যে থেকেই ধর্ষণ করা হচ্ছে। সুতরাং প্রথম ও দ্বিতীয় কারণ খুব একটা যুক্তিসংগত না।

তৃতীয় কারণ, যেটি ধর্মীয় শিক্ষার অভাব সেটিও খুব একটা সফলতা এনে দিয়েছে তা বলা যায়না! মাদ্রাসার হুজুর দ্বারা ধর্ষণ, মসজিদের ইমাম দ্বারা ধর্ষণ, পাদ্রী দ্বারা ধর্ষণ, পণ্ডিত দ্বারা ধর্ষণ এমনকি পরিবারের লোক দ্বারা ধর্ষণ এমন খবরও পত্রিকায় কম ছাপা হয় না। এদের প্রত্যেকেই নিজেদের ধর্মীয় শিক্ষায় অনেক বেশি শিক্ষিত! এই শিক্ষাটাও তাদের এই কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

চতুর্থ কারণ যেটি বলে অনেকে, বিচারহীনতা। এটি মৌলিক কারণ না হলেও মোটামুটি পর্যায়ের কারণ হিসেবে ধরা যায়। মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা খুবই প্রাচীনতম কৌশল কিন্তু এর ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি না। কেউ যদি ধর্ষণ করে তাকে শাস্তি দিয়ে কখনো ধর্ষণ চিরতরে বন্ধ করা সম্ভব নয়।একটি রাষ্ট্র একটি সিস্টেম। কোন ব্যাক্তি না যে সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে প্রতিশোধ নিবে। কেউ ধর্ষণ করলে কাওকে শাস্তি দিলে সেই সমস্যার সমাধান হয়না। সেই কাজ না করার জন্য তার মনে কেবলমাত্র ভীতি তৈরি হয় কিন্তু তার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ তৈরি হয়না।
তাহলে আবার সেই প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক। মানুষ কেনো ধর্ষণ করে?

এর সহজ উত্তর হচ্ছে তার সেক্স পায় তাই ধর্ষণ করে। জ্বী, অনেকগুলো মৌলিক কার্যক্রমের মধ্যে সেক্স একটি। কারো ক্ষুদা পেলে সে খাবে, কারো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন হলে দেবে। কারো হাসি পেলে সে হাসবে, কারো কান্না পেলে সে কাঁদবে। ঠিক এটাও অনেকটা সেরকম। কারো সেক্স পেলে সে সেক্স করবে।

কিন্তু তাই বলে ক্ষুদা পেলে একজনের খাবার আরেকজন ছিনিয়ে খাবে না, এটা কখনো কোনো সভ্য মানুষের কাজ না। তবে পশুদের মধ্যে এই স্বভাব আছে। ঠিক সেক্স পেলে কাউকে ধর্ষণ করে ফেলা কোনো সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না।
বিষয়টি সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটি থিউরির মাধ্যমে আলোচনা করা যাক।
এই বিখ্যাত মনরোগ বিশেষজ্ঞ মানব মনকে তিনটি স্থরে ভাগ করেছেন।
ইড, ইগো এবং সুপার ইগো।
ব্যাপারগুলো উদাহরণ দিয়ে উপস্থাপন করছি।
আমার এখন খিদে পেয়েছে। আমাকে খেতে হবে। যে করেই হোক খেতে হবে। আমার কাছে খাবার না থাকলে ছিনিয়ে খেতে হবে। আমার ক্ষুদা নিবারণ করাই মূখ্য উদ্দেশ্য। এই প্রবণতাটি হচ্ছে ইড। মানব মনের এই স্তর কোন যুক্তি মানে না, নিয়ম দেখে না, আইন শৃঙ্খলার ধার ধারে না। তার প্রয়োজন সে যে করেই হোক মেটাবে। দূর্নীতি করে হোক বা লুটপাট করে হোক সে আদায় করে ছাড়ে।

ইগো হচ্ছে এই ইডকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে। সে ইডকে বলে এভাবে করা যাবেনা। তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, শাস্তি হতে পারে, তোমাকে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখবে। উদাহরণ, একজনের সেক্স পেলো। কিন্তু তার এই চাহিদা মেটাতে সহজলভ্য কোন সমাধান তার কাছে নেই। ইড সিদ্ধান্ত নিলো রেপ করে এই চাহিদা মেটাবে। ঠিক সেই সময় ইগো বলবে রেপ করা যাবেনা। কেউ জানতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, জেল জরিমানা হবে, তোমার মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনরা জানতে পারলে তোমাকে ঘৃণা করবে। এসব বলে ইগো ইডকে কনভিন্স করে। কিন্তু এই ধারণা তার মন থেকে যায়না। সেক্ষেত্রে যদি ইড ডোমিনেন্ট করে তাহলে সে কাজটি করে বসে। রেপ করার আকাঙ্খা থেকে ভয়ের কারণে বিরত থাকলেও তার মনের মধ্যে এই বাসনা সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়।

যদি ব্যাপারটা এমন হয় কোন ক্ষমতাবান লোক সে ক্ষমতা ও টাকার জোরে সবকিছু ধামাচাপা দিতে পারবে। অথবা কোন পুলিশ যদি দূর্ণীতি করে তার ও তার পরিবারের বিলাসিতা মেটায় তখন ইগো ইডকে কোনভাবেই কনভিন্স করতে পারবেনা। এই সব মানুষগুলোর ইড তার ইগোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলবে তুমি মিয়া চুপ থাকো! বেশি বুঝতে আসিওনা! আমি সব সামলে নিবো!

ঠিক সেই মুহূর্তে প্রয়োজন হয় সুপার ইগোর। সুপার ইগো ন্যায়, নীতি, মানবিকতা, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ এসবকিছু নিয়ে কাজ করে। ভয় দেখিয়ে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা আর লোভ দেখিয়ে ভালো কাজ করানোর কৌশলে ইগো কাজ করলেও সুপার ইগোর কাছে এসবের কোন মূল্য নেই। সুপার ইগো বুঝে ভালো কাজ করা ভালো বলেই করতে হবে, খারাপ কাজ খারাপ বলেই বিরত থাকতে হবে। উপরে বর্ণিত সেই ক্ষমতাবান লোক অথবা দুর্নীতিবাজ পুলিশটিকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য সুপার ইগোর প্রয়োজন। এখন কথা হচ্ছে সেই সুপার ইগো কয়জনের মধ্যে রয়েছে! অথবা কিভাবে এই সুপার ইগো মানুষের মধ্যে জাগ্রত করা যায়।

সবার মধ্যে একটা কমন বোধ ইন্সটল করতে হবে সেটি হচ্ছে মানবিকতা, মনুষ্যত্ব, ন্যায়নিষ্ঠা। কিন্তু মানুষ কোন কম্পিউটার নয় যে সফটওয়্যার ইন্সটল করে দিলেই কাজ শেষ! এই কাজটি একটা প্রক্রিয়া যার বাহক হতে পারে সঠিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।

আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে যে সমস্ত ধর্ষণ হয়েছে সেগুলো নিয়ে কি কোন গবেষণা হয়েছে? ধর্ষকদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে কোন গবেষণা পত্র আছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে কি এসব বিষয়ে কোন কেইস স্টাডি করানো হয়? মানুষের সুপার ইগোকে জাগ্রত করার জন্য এই ধরনের গবেষণা খুবই প্রয়োজনীয়।
পাঠ্যপুস্তকে সেক্স এডুকেশন অন্তর্ভূক্ত নিয়েও অনেকের সমস্যা আছে। এই সমস্যা কেনো হয় সেটা নিয়ে কি কেউ কখনো ভেবেছে? আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে কত বিকৃতমনা হলে পাঠ্যপুস্তক থেকে সেক্স এডুকেশন নিষিদ্ধ করার দাবী তুলে!

আমরা যখন কোন শব্দ শুনি সেই শব্দের একটা ইমেজ কল্পনা করি। মানুষের মস্তিষ্ক এভাবেই প্রতিক্রিয়া করে। আপেল বললে চোখে একটা আপেল ভেসে উঠাই স্বাভাবিক। ঠিক তেমনি সেক্স এডুকেশন শুনলে স্বাভাবিকভাবেই কিছু মানুষের মাথায় চলে আসে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে সেক্স করছে সেই শিক্ষাটাই দিচ্ছে! ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর হলেও এটিই বাস্তবতা। সেক্স এডুকেশনের বিকল্প কোন নাম কেনো দেয়া হচ্ছেনা? সেক্স এডুকেশন মানেই যে সেক্স করা না তা খুব সহজেই এই শব্দ পরিবর্তন করে বোঝানো সম্ভব।

সুপার ইগোকে প্রতিষ্ঠিত করা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। কিন্তু বর্তমানে এর প্রতিকার করতে ইগোকে আরো কার্যকরী করার জন্য সঠিক ও দ্রুত বিচারব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই।
-শেখ মনজুরুল ইসলাম