শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে লাইসেন্স বাতিল হবে মানসিক হাসপাতালের

ডিসেম্বর ৮, ২০২০

রাজধানী ঢাকায় মাত্র ১৫টি বেসরকারি মানসিক হাসপাতালের অনুমোদন রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অথচ রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের উল্টোদিকে কেবল মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোড, রিংরোডসহ শ্যামলী এলাকাতে গেলেই এসব বেসরকারি হাসপাতালের বেশিরভাগের দেখা মেলে। আর এগুলোর অধিকাংশেরই লাইসেন্স নেই। নেই সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত বেড সংখ্যা, সে অনুপাতে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীও অনুপস্থিত।
আর স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, নতুন করে এসব বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল-ক্লিনিক নিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে কেবল কার্যক্রম স্থগিত হয়, স্থায়ীভাবে এসব হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করার কথাও ভাবছেন তারা।

আর এসব বেসরকারি হাসপাতালে একইসঙ্গে চলছে মানসিক রোগ এবং মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে। চিকিৎসকরা বলছেন, মানসিক রোগ এবং মাদকাসক্তকে এক করে এসব বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা চলছে যা কিনা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত নয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বেসরকারি এসব মানসিক হাসপাতালের বেশির ভাগেরই পরিবেশ উপযুক্ত নয়, তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাও বিজ্ঞানসম্মত নয়। মারধর, বাগান করানো, গান গাওয়ানোসহ সব অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এখানে চিকিৎসা চলে। রোগীদের কাউন্সিল করানোর দরকার হলেও সেখানে কাউন্সিলর নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্ধারিত শর্ত না মেনেই প্রকাশ্যে তারা চিকিৎসার নামে এসব চালিয়ে যাচ্ছে।

তাদের দাবি মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে এসব ক্লিনিক হাসপাতালে তালা ঝুললেও কয়েকদিন পরই সেগুলো খুলে দেওয়া হয়। আর এটা সম্ভব হচ্ছে প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে।

বিভাগভিত্তিক লাইসেন্স পাওয়া বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্তি পরার্মশ কেন্দ্র, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের তালিকা থেকে দেখা যায়, তাদের বেশির ভাগেরই বেড সংখ্যা ১০টি করে উল্লেখ রয়েছে। অথচ ভেতরে রয়েছে ১০ শয্যার বেশি। আর ১০ শয্যা করে লাইসেন্স নেওয়ার কারণ হচ্ছে, তাতে করে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য জনবল অনুপাতে কম দেখাতে পারে তারা। একইসঙ্গে এসব ক্লিনিকের নেই সঠিক অবকাঠামো।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র জানায়, ১০ শয্যার বেডের মানসিক হাসপাতাল-ক্লিনিকের জন্য তিনজন চিকিৎসক, ছয়জন নার্স ও তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকা বাধ্যতামূলক। আর এই শয্যাসংখ্যা যত বাড়বে সেই হারে জনবলও বাড়ার কথা।

বেসরকারি এসব মানসিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কথা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক সমূহ) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিঞা বলেন, জনবল তাদের প্রধান সমস্যা। প্রতি মাসে বেসরকারি মানসিক হাসপাতালগুলোতে অধিদফতর থেকে অভিযান পরিচালনা করার কথা থাকলেও কেবলমাত্র লোকবল সংকটের কারণে তারা সেটি পারছেন না।

আর অধিদফতরের এই দুর্বলতার কারণেই বেসরকারি মানসিক হাসপাতালগুলো তাদের ইচ্ছামতো করে হাসপাতাল পরিচালনা করছেন। তবে এতদিনে না হলেও গত কয়েকদিন আগে মাইন্ড এইড হাসপাতালে পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমের মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবছেন তারা।

বিষয়টি নিয়ে না ভেবে উপায় নেই, এগুলো দেখতে হবে বলে উল্লেখ করেনি তিনি। ঢাকা মহানগরীর জন্য পৃথকভাবে টিম করে দেওয়া হয়েছে, তারা ইন্সপেকশন করছে, কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, লাইসেন্স যেমন স্বাস্থ্য অধিদফতর দেয় তেমনি শর্ত ভঙ্গ করলে লাইসেন্স স্থগিত করার কিংবা বাতিল করার ক্ষমতাও রাখে। ইতোমধ্যে দেশের সব সিভিল সার্জন এবং বিভাগীয় পরিচালককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে অধিদফতর থেকে। যারাই আমাদের শর্ত মানবে না, কিংবা না মেনে এতদিন পরিচালিত হয়েছে সেটা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বন্ধ অথবা জরিমানা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। আমরা বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল-ক্লিনিক নিয়ে নতুন করে ভাবছি, বলেন ডা. ফরিদ উদ্দিন মিঞা।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. শহিদুল্লাহ বলেন, ব্যাঙের ছাতার মতো এসব বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। আর এসবের বেশিরভাগই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের কাছাকাছি। বিভিন্নভাবে এসব হাসপাতালে রোগীরা আসছেন, ভর্তি হচ্ছেন কিন্তু তারা কতটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন সেটা বড় প্রশ্ন। কারণ এখানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোনও চিকিৎসা হয় বলে মনে হয় না।

তাই এখানে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে, কেউ যেন চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা করার সুযোগ না পায়, কোনও নাগরিক যেন অপচিকিৎসার শিকার না হয় সেটি দেখা, তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স নিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া যাবে না-কারণ মাদকাসক্তি নিজেই একটি রোগ-এটা আন্তর্জাতিকভাবে সংজ্ঞায়িত, বলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, আর মাদকাসক্তি যেহেতু একটি রোগ তাই মাকদাসক্তি রোগের চিকিৎসায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, পরামর্শ কেন্দ্র, পুনর্বাসন কেন্দ্র-এসব কিছুর লাইসেন্স এবং তত্ত্বাবধান স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন হতে হবে। তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে, নয়তো বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালগুলোতে অপচিকিৎসা চলতেই থাকবে।