শেষ পর্যন্ত মার্কিন নির্বাচনের মীমাংসা কি আদালতে?

নভেম্বর ৫, ২০২০

ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে কোনও প্রমাণ ছাড়াই ভোটে জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন, জর্জিয়া ও মিশিগান অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনা বন্ধ করতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে ট্রাম্প শিবির। এর ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

এতক্ষণে কী ফলাফল জানা উচিত নয়?

নির্বাচনের পর এরইমধ্যে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এতক্ষণে আমাদের কী ফলাফল জানা উচিত নয়? এর উত্তর আসলে হ্যাঁ কিংবা না যেকোনওটি হতে পারে।

সাধারণত বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রাপ্ত ফলে যখন একজন প্রার্থী বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হন তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোও সেটি প্রচার করতে শুরু করে। ২৭০ বা তার বেশি ইলেক্টোরাল ভোট পাওয়া প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন সে ব্যাপারে সচরাচর ভোটের পরদিন সকালে জানা যায়।

সংবাদমাধ্যমগুলো যে ঘোষণা দেয় সেটি কোনও অফিসিয়াল বা চূড়ান্ত ঘোষণা নয়। তারা শুধু বাস্তব তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে নির্বাচনি ফলের ব্যাপারে তাদের প্রজেকশন হাজির করে। আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশে সাধারণত কয়েক দিন লেগে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এবার রেকর্ড সংখ্যক প্রায় ১০ কোটি আগাম ভোট পড়েছে। প্রচুর পরিমাণ পোস্টাল ভোট পড়ায় ডাকযোগে এগুলো পৌঁছানোর পর সেগুলো গুনতে স্বভাবতই বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হবে।

কিছু সুইং স্টেটে ৩ নভেম্বরের মূল নির্বাচনের আগে পোস্টাল ভোট গণনা করা হয়নি। ফলে স্বভাবতই যাচাই-বছাই করে ভোট গণনার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তাদের বাড়তি সময় লাগবে।

বাইপারটিসন পলিসি রিসার্চ সেন্টারের নির্বাচন প্রকল্পের পরিচালক ম্যাথিউ ওয়েইল। তার মতে, দুই প্রার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতা খুব কাছাকাছি থাকলে এবং কেউই হার স্বীকার না করলে ভোট গণনা অব্যাহত থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে বিজয়ী প্রার্থীকে বেছে নিতে বিলম্ব হতে পারে।

বিপত্তি ভোটের আগে থেকেই

৩ নভেম্বর ভোটগ্রহণের আগেই পোস্টাল ও আগাম ভোট নিয়ে ৪৪টি রাজ্যে ৩০০-এরও বেশি মামলা হয়েছে। মূলত ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে করা এসব মামলায় ব্যালট পোস্ট করার এবং সেগুলো গ্রহণের সময়সীমা, সাক্ষীর স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তার মতো নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।

রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলো বলছে, ভোটারদের জালিয়াতি ঠেকাতে বিধিনিষেধের প্রয়োজন ছিল। তবে ডেমোক্র্যাটদের অভিযোগ, রিপাবলিকানরা আসলে আমেরিকার জনণগকে তাদের নাগরিক অধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে।

ট্রাম্প শিবিরের সৃষ্ট যত চ্যালেঞ্জ
উইসকনসিন

ট্রাম্প শিবির বলছে, উইসকনসিনে ভোট গণনায় ‘অস্বাভাবিকতার ওপর ভিত্তি করে’ তারা সেখানে ভোট পুনঃনিরীক্ষণের অনুরোধ করেছে। তবে তাদের দাবি অনুযায়ী, সেখানে পুনরায় ভোট গণনা হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সাধারণত কাউন্টি কর্মকর্তারা পর্যালোচনার আগে পুনরায় ভোট গণনা করা হয় না। এই রাজ্যে ভোট গণনা শেষ হওয়ার সময়সীমা আগামী ১৭ নভেম্বর।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন স্কুলের প্রফেসর রিচার্ড ব্রিফল্ট বলেন, উইসকনসিনে ২০১৬ সালেও পুনরায় ভোট গণনা হয়েছিল। তখনও প্রায় শখানেক ভোট পরিবর্তিত হয়েছিল।

প্রফেসর রিচার্ড ব্রিফল্ট বলেন, ‘পুনর্গণনা ভোটের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর উপায় নয়। বরং এটি হচ্ছে ভোটের হিসাব সঠিক কিনা তা নিশ্চিত করার আক্ষরিক একটি উপায়।’

মিশিগান

২০১৬ সালের নির্বাচনে মাত্র ১০ হাজার ৭০০ ভোটের ব্যবধানে মিশিগানে জয় পান ট্রাম্প। এবার নির্বাচনের পরদিন ৪ নভেম্বর সেখানে ভোটগণনা বন্ধের জন্য মামলার ঘোষণা দেয় ট্রাম্প শিবির। যদিও ততক্ষণে ৯৬ শতাংশ ভোট গণনা সম্পন্ন হয়ে গেছে। এরইমধ্যে সেখানে জয়ের দ্বারপ্রান্তে আছেন বাইডেন।

ট্রাম্প শিবির যখন মামলার ঘোষণা দেয় তখনও হাজার হাজার ভোট গণনা করা হয়নি। এসব ভোটের একটা বড় অংশই এসেছে ডেমোক্র্যাট অধ্যুষিত এলাকাগুলো থেকে। অর্থাৎ বাদবাকি ভোট গণনা সম্পন্ন হলে সেগুলোও বাইডেনের ঝুড়িতেই যোগ হওয়ার কথা।

পেনসিলভানিয়া

এখানে ট্রাম্প শিবিরের আপত্তির জায়গা মূলত পোস্টাল ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে। রাজ্য সরকার তিনদিন পর্যন্ত এসব ভোট গণনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে ট্রাম্প শিবির।

জর্জিয়া

জর্জিয়ার চ্যাথাম কাউন্টিতে ভোট গণনা বন্ধ করতে মামলা করেছে ট্রাম্প শিবির। তাদের অভিযোগ, সেখানে অনুপস্থিত ভোটারদের ব্যালটের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে।

জর্জিয়ার রিপাবলিকান চেয়ারম্যান ডেভিড শফার টুইট করেছেন যে, তার দলীয় পর্যবেক্ষকরা একজন নারীকে ৫০টিরও বেশি ব্যালট অনুপস্থিত ভোটারদের ব্যালটের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে দেখেছে। ফলে সেসব ভোট আর গণনার সুযোগ নেই।

অনিশ্চয়তা কতদিন?

যেহেতু এটি প্রেসিডেন্টের পদ তাই এ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটি সমাধানে পৌঁছানোর ব্যাপারে সাংবিধানিক সময়সীমা রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোন প্রার্থী জিতেছেন তা নির্ধারণের জন্য রাজ্যগুলোর হাতে ৩ নভেম্বর থেকে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ সময় রয়েছে। এটিকে ‘‌সেফ হারবার’ ডেডলাইন বলা হয়। এ বছর এই ডেডলাইন আগামী ৮ ডিসেম্বর।

অঙ্গরাজ্যগুলো নির্ধারিত ডেডলাইনের মধ্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সমর্থ না হলে পপুলার ভোটের বদলে ইলেক্টোরাল কলেজের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাছাই করা হবে।

সিনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রতিনিধি পরিষদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। প্রতিনিধি পরিষদে স্টেট ডেলিগেটরা একটি করে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে ২৬ জনের ডেলিগেটের সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। যাই ঘটুক না কেন; ২০ জানুয়ারির মধ্যে অবশ্যই নতুন প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শুরু হবে।

বাইপারটিসন পলিসি রিসার্চ সেন্টারের নির্বাচন প্রকল্পের পরিচালক ম্যাথিউ ওয়েইল বলেন, ২০ জানুয়ারি দুপুরে একজনকে আমাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে হবে।

ম্যাথিউ ওয়েইল বলেন, এমনও হতে পারে হোয়াইট হাউজের আসন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই সিনেট একজনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে চূড়ান্ত করতে পারে।

তিনি বলেন, প্রতিনিধি পরিষদ যদি প্রেসিডেন্ট বাছাইয়ে ব্যর্থ হয় তাহলে সিনেটে নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্টই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন। কোনও কারণে ভাইস প্রেসিডেন্টও যদি নির্বাচিত করা না যায় তাহলে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার দেশ শাসনের দায়িত্ব পাবেন। উল্লেখ্য, বর্তমান স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বাইডেনের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা।

নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের নজির খুব বেশি নেই। তবে এবার দুই দলেরই প্রচারণা টিম থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচনের পর আইনি লড়াইয়ের জন্য তারা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে। দুই দলই আইনজীবীদের বড় দল তৈরি রেখেছে ভোট গণনা নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জ লড়ার জন্য। এসব আইনি চ্যালেঞ্জ শেষ পর্যন্ত আমেরিকার সর্বোচ্চ আইনি কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে। এমনটা ঘটেছিল ২০০০ সালের নির্বাচনে। তখন রিপাবলিকান প্রার্থী ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ছিলেন আল গোর। পরে ফ্লোরিডায় ভোট পুনর্গণনা সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে বুশকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তবে এবার শেষ পর্যন্ত কী হয় সময়ই তা বলে দেবে।