বাবু ভাই, এক পেশাদার সাংবাদিকের প্রতিকৃতি

জুলাই ১১, ২০২০

রিপোর্ট জমা দেয়ার কিছুক্ষণ পরই বাবু ভাই আমার টেবিলে হাজির। ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। কী ভুল করলাম! সামনে চেয়ারে বসে তিনি আমার কাছ থেকে আরো কিছু জানতে চাইলেন। যে টুকু জানা ছিল, বললাম। তিনি এবার ভাবীকে ফোন দিলেন। ভাবী মানে বাবু ভাইয়ের স্ত্রী। তিনি সাইন্স ল্যাবটরির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। আমার রিপোর্ট নিয়ে কথা বললেন দু’জনে। রিপোর্টে আমি যা বলতে চেয়েছি, তার চেয়ে আরো বেশি বুঝতে চান বাবু ভাই। কারণ ভাবী বিশেষজ্ঞ। পরে মুচকি হেসে বললেন, ভালো লিখেছো। তোমার নাম কি? শুনে রিপোর্টের উপর নিজ হাতে লিখে দিলেন আমার নাম।

(সাংবাদিক রাশিদ উন নবী বাবু)

যখন লেখছি, বাবু ভাইকে তখন আপন করে নিয়েছে তার জন্মভূমি বগুড়া। চীরদিনের জন্য শুয়ে পড়েছেন মাটির কোলে। এক সময়ের প্রিয় ঢাকা হয়ত এখন তাঁর কাছে বড় অপরিচিত। নির্মম এক মহানগরী। যতই ভালবাস আপন হয় না। হ্যাঁ বলছিলাম একজন প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিক রাশিদ উন নবীর কথা। আমাদের কাছে যিনি-বাবু ভাই। শিক্ষানবিশ সাব এডিটর থেকে যিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠে ছিলেন মূলধারার পত্রিকার সম্পাদক।

দেশে সাংবাদিকতা নিয়ে এখন কত কী হচ্ছে! বাটপারকে রাতারাতি রাজনৈতিক বিশ্লেষক বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেবল মধ্য রাতে ঝগড়া করে হয়ে যেতে চাচ্ছেন জাতির বিবেক! মহা সজ্জন! এমন এক কঠিন সময়ে বাবু ভাইয়ের মতো একজন প্রকৃত পেশাদারের চলে যাওয়া বড় হতাশার, বড় বেদনার।

দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাবু ভাই। আমরা ফেসবুকে পোস্ট দিলাম- ‘ক্ষমা করবেন, আমার করার কিছু ছিল না।’ এ অসহায়ত্বের প্রকাশই শেষ। কিন্তু বাবু ভাইয়ের সম্পদই ছিল সহকর্মীর সম্মিলিত শক্তি, সক্ষমতা। মেয়ে অনন্যাকে হয়ত হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে তিনি তা বলতেন। কিন্তু শক্তিটা কাজে আসলো না। বাবু ভাই হয়ত আমাদের ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু অনন্যা কি পারবে? ঘোর বিপদে তার বাবার পাশে আমরা কেন দাঁড়াতে পারলাম না। কত জনই তো এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের সহায়তা পেলেন। বাবু ভাই কেন পেলেন না?

লম্বা। ফর্সা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আর মাথা ভর্তি লম্বা চুল ছিল বাবু ভাইয়ের। দেখা হলেই কাছে এসে হাত বাড়াতো। হাত মেলাতে নয়। হাতটি সোজা কাঁধে রাখতেন। তারপর মুচকি হেসে প্রশ্ন করতেন, কেমন আছো? কোথায় কাজ করছো? আরো জানার চেষ্টা করতেন পরিবারের সদস্যদের কথাও। এক সাথে কাজ করার সুবাদে তাঁর ‘শিষ্য’ হয়েছি বটে! কিন্তু তাঁর গুণের কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি? নিজের কাছে নিজে এ প্রশ্ন করি আজ বার বার।

বাবু ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা ১৯৯৮। তিনি তখন আজকের কাগজের বার্তা সম্পাদক। আমি মস্কো থেকে কেবল ফিরেছি। নাট্য নির্মাতা, বন্ধু অরণ্য আনোয়ার, আনোয়ারুল হক এবং আমি যোগ দিলাম আজকের কাগজে। অফিস ঝিকাতলায়।

সিনিয়র সাংবাদিক শহীদুজ্জামান প্রথম দিনই বাবু ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি নিজ টেবিলে বসে কপি দেখছিলেন। মাথা উচিয়ে, কপালের ঝুলে পড়া চুল হাত দিয়ে সরিয়ে বললেন, সাথে কী আছে? লিখে দাও।

মন খারাপ হয়ে গেল। কুশলটাও জানতে চাইলেন না!

নিজেকে সামলে নিলাম। বুঝলাম, এ লোককে কাজ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে খুশি করা যাবে না।

নিজ টেবিলে ফিরে ভাবছি, কী লিখবো? মহাখালীর নিপসন থেকে ঝিকাতলায় গিয়েছি। হাতে নিপসনের একটি গবেষণা পত্র। সেটা থেকেই লিখে ফেললাম রিপোর্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টিতে, আর্সেনিক মহা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।

রিপোর্ট জমা দেয়ার কিছুক্ষণ পরই বাবু ভাই আমার টেবিলে হাজির। ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। কী ভুল করলাম! সামনে চেয়ারে বসে তিনি আমার কাছ থেকে আরো কিছু জানতে চাইলেন। যে টুকু জানা ছিল, বললাম। তিনি এবার ভাবীকে ফোন দিলেন। ভাবী মানে বাবু ভাইয়ের স্ত্রী। তিনি সাইন্স ল্যাবটরির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। আমার রিপোর্ট নিয়ে কথা বললেন দু’জনে। রিপোর্টে আমি যা বলতে চেয়েছি, তার চেয়ে আরো বেশি বুঝতে চান বাবু ভাই। কারণ ভাবী বিশেষজ্ঞ। পরে মুচকি হেসে বললেন, ভালো লিখেছো। তোমার নাম কি? শুনে রিপোর্টের উপর নিজ হাতে লিখে দিলেন আমার নাম।

সকালে পত্রিকা দেখে চোখ মাথায় উঠার জোগাড়। রিপোর্টটি লিড, মানে প্রধান খবর। সাত কলামে লিড। এমনই ছিল আমাদের বাবু ভাই। রিপোর্টারকে চেনেন না। কিন্তু তার রিপোর্ট লিড করতে দ্বিধা করতেন না। যদি মেরিট থাকে।

বাবু ভাইয়ের সাথে সখ্যতা হয়ে গেল। প্রায়ই ডেকে নিয়ে ব্রিফিং দিতেন। পরামর্শ দিতেন। কিন্তু কখনো নিজের সম্পর্কে কিছু বলতেন না। আমরা তাঁর পত্রিকা মেকাপের প্রশংসা করলে কেবল মুচকি হাসতেন। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সেই মুচকি হাসা মুখটিই বার বার মনের মনি কোঠায় ভেসে উঠছে।

আজকের কাগজ ছেড়ে বাবু ভাই যোগ দিলেন দৈনিক আমার দেশ-এ। প্রয়াত সাংবাদিক ও অগ্রজ প্রতিম ওমর ফারুক বললেন, বাবু ভাই আপনাকে খুঁজছেন। জানালেন, আমার দেশ-এর ক্যাম্প অফিসে যোগাযোগ করতে বলেছেন। ডে অফ এ চলে গেলাম।

যেতেই চায়ের অর্ডার দিয়ে বললেন, আমার দেশ এ যোগ দাও। আমি ইতস্তত করি। উদ্যোগক্তাদের সম্পর্কে জানতে চাই। পাশে বসা ছিলেন, জনকণ্ঠের চিফ রিপোর্টার আহমেদ নূরে আলম, সিনিয়র রিপোর্টার ইলিয়াস খান, সমকালের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তাফিজ শফি। তাঁরাও জানালেন যোগ দেবেন। যোগ দিলাম আমার দেশ-এ।

বাবু ভাই ছিলেন, নবীনদের প্রতিষ্ঠিত করার এক বড় কারিগর। অনেক স্মৃতির মধ্যে আরেকটা খুব মনে পড়ে। আমার স্ত্রী লিরা চারুকলার ছাত্রী। বাবু ভাই তা জানতেন। একদিন অফিসে আমাদের দু’জনকে এক সাথে আসতে বললেন। গেলাম। চা খাওয়ার ফাঁকে উনি ইমদাদুল হক মিলনকে ডেকে পাঠালেন। অনুরোধ করলেন লিরার আঁকা ছবি দিয়ে অন্তত তাঁর দু’টি বইয়ের প্রচ্ছদ করতে।

বিশিষ্ট লেখক মিলন ভাই তখন আমার দেশ-এর সাহিত্য সম্পাদক। তিনি রাজীও হলেন। পরবর্তী উপন্যাসের বিষয়বস্তু বুঝিয়ে প্রচ্ছদ আকঁতে বললেন লিরাকে।

বাবু ভাই নিজে বললেন, আমার দেশ’র ভেতরের পাতাগুলোর অলংকরণ করতে। আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষেরও কোনো ছাত্রীকে নিয়ে এতো বড় ঝুঁকি কেবল বাবু ভাই-ই নিতে পারতেন।

কৃষক দলের সাথে এক সময় সম্পৃক্ত ছিলেন বাবু ভাই। এক দিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিপরীত ধর্মী এমন পরিচয় থাকা সত্ত্বেও বাংলার বাণীতে কাজ করতেন কীভাবে? তিনি বিনয়ের সাথে জানালেন, রাজনীতি আর সাংবাদিকতা দু’টো ভিন্ন জিনিস। একটা দিয়ে অন্যটাকে প্রভাবিত করতে চাইলেই যত সমস্যা। তুমি পেশাদার হলে কাজ করতে অসুবিধা কি? সম্পাদকীয় নীতিটা মেনে কাজ করবে। যা সত্য মনে হবে তা লিখবে। কাউকে অযথা বড় বা ছোট করতে যাবে না। যে যত টুকু ডিজার্ভ করে তাকে নিয়ে ততো টুকু লিখবে। দেখবে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আমারও হয়নি। বরং বাংলার বাণীর সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অগ্রজতুল্য শফিকুল আাজিজ মুকুল, আজিজ মিসির ও মীর নূর ইসলামের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। দৈনিক বাংলা, ইনকিলাব, দেশবাংলা, সকালের খবর, দিনকাল এ কাজ করেছেন বাবু ভাই। কোনো হাউজ সম্পর্কেই তাঁর কোনো অনুযোগ ছিল না। একটা বিকালের কাগজ ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করতে অনেক পরিশ্রম করেছেন। সফল হননি। কিন্তু কোনো হতাশা ছিল না। বলতেন, অনেক কিছু শিখলাম। জানলাম।

কেবল তিনি সময় মতো জানতে পারলেন না ক্যান্সারের আক্রমণটাকে। আর একটু আগে জানতে পারলে হয়ত বেঁচে যেতেন। সৃষ্টি করতে পারতেন আরো একটি নতুন পাঠক প্রিয় দৈনিক।

আপনার প্রতি অনেক অনেক সশ্রদ্ধ সালাম বাবু ভাই। মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাত দান করুন।

লেখক- মুহাম্মদ আলম, সিনিয়র সাংবাদিক।