‘তাসের খেলায় একটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট’

জুলাই ৮, ২০২০

সাহেদ আসলে যে জোকার; সে এইসব শাসক শোষক পরিতোষক ভ্রান্ত নীতিধারক, ঠোঁট সেবার পাপিয়া, টেকাটুকা সেবার পাপলু, ‘সাতে পাঁচে থাকি না’ দাদা, ‘দুইটা চোখ দেখবা, দুইডা কান শুনবা; একটা মুখ তো কম কথা’ ভাইয়া; হাওয়া-চেতনা-বিপদের বাঁশী ভবনের সুচিন্তক; হেফাজাতক-জামাতক-ওলামা-কেরামত সবার মুখমণ্ডল জুড়ে অসত সাহেদের মুখোশ পরিয়ে দিয়ে; জোকারের মতো কান্নার সময় অট্টহাসিতে সাহেদ বলে, ক্যাচ মি; ইফ ইউ ক্যান।

সাহেদের চেহারাটা আমি চিনি। যতদূর মনে পড়ে সে খুব সহজ সরল প্রকৃতির ছেলে ছিলো। আজ সাহেদের ছবি দেখে; সবাই যেমন ভাবছে; এতোসব গুণীজনেরা কেনো সাহেদের সঙ্গে ছবি তুলেছে; সাহেদের জীবনটা সবসময়ই এরকম ছিলো। সে একটু স্লো পারফরমার; অতটা চালাক চতুর নয়; যা থাকলে বন্ধু বৃত্তে আড্ডায় তাল মেলাতে পারবে।

আমাদের সমাজে স্কুলের একটা শিশু কেনো একা একা হাঁটছে; গাছের ডাল-পাতা হাওয়ায় ঘুরিয়ে কী যেন গল্প করছে; তা দেখার ও বোঝার অবকাশ অভিভাবকের নেই; শিক্ষকের নেই।

প্রত্যেকটা আড্ডায় সাহেদকে ফিরতে হয় প্রত্যাখানের বেদনা নিয়ে। ‘জোকার’ ছবির জোকার যেমন প্রত্যাখ্যানের বেদনায় লীন হয়েছিলো; অপমানে কুঁকড়ে গিয়েছিলো; কেউ বুঝতে চায়নি জোকার কান্না পেলে কেনো হাসে।

বিভিন্ন জায়গায় কোনো অনুষ্ঠান হলের লবিতে একা একা বিড় বিড় করে কথা বলতে বলতে ফেরা ছেলেটি কান্না-লুকানোর বেদনার প্রায় তিনটি দশক কাটানোর পর সে জোকারের মতো নৈরাজ্যে ঘুরে দাঁড়ায়।

সে একা একা চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখে; মি. বিন দেখে; তার মনে হয় এ সমাজ তাকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবেই নেবে। এতোদিনের সাহেদ তো শুধু প্রত্যাখ্যান পেয়েছে।

খেলার মাঠে আড্ডায় প্রত্যাখ্যাত হলে; তখন পড়ার টেবিলে বসে পড়া ছাড়া শিশুর তো আর কোনো উপায় থাকে না। ফলে একটু ইংরেজিটা পড়তে পারা; দুটি ইংরেজি চিঠির ড্রাফট করে দেবার ক্ষমতা জন্মে যায়। আর সহমত ভাইদের প্রধান দুর্বলতা ইংরেজিতে। কারণ বড় রাজনীতিকের ছেলে-মেয়েরা বিদেশে পড়ে। আর তারা খুব করে সর্বস্তরে মাতৃভাষাটা ঘষে দিয়েছেন। তাই রাজনীতির ফুটসোলজাররা এক ভাষার; এক মতের; টেকাটুকার পথের আর রাজনীতির মাজারে হাউমাউ করে কাঁদবার। কাজের কাজ তো হবার জো নেই। জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় ‘স্প্লিন্টার পিঠে লেগেছিলো’ কোটায়; একভাষী একদলীয় লোক নিয়োগ দিলে বাংলা বাক্যের পাঁচটা লাইনের আড়ে আড়ে বানান ভুল করে রাখে।

সুতরাং ইংরেজি চিঠি লিখতে পারা সাহেদ; ইংলিশ হার্টথ্রব হিসেবে ডাক পায়। সাহেদ মি. বিন হয়ে ক্ষমতার রঙ্গভবনে ঢুকে বিদূষকদের সঙ্গে ছবি তোলে; রাষ্ট্রপতির চেয়ে রাষ্ট্রক্যামেরায় তার মনোযোগ বেশি থাকে; বিদূষকেরা টকশোতে ডাকলে সেখানে গিয়ে দু’কথা বলে আসে।

মুন্নাভাই এমবিবিএস ফিল্ম দেখে তার মনে হয়; ডাক্তার নইতো কী হয়েছে; রাজসিক হাসপাতাল খুললে ক্ষতি কী। ফেসবুকে চেতনার চেকপোস্ট ও ধর্মের চেকপোস্টে যারা ইমান পরীক্ষা করে বেড়ায়; তারা মুন্নাভাইয়ের কাছে চাকরি চাইলে; তাদের ডায়াগনিস্টিক সেন্টারে চাকরি দিয়ে দেয়। এ হাসপাতাল যে ইউনাইটেড কিংবা ডিএমসি-র চেয়ে খারাপ হাসপাতাল; তা তো নয়। ডি এমসিতেও ওয়ার্ড বয় সার্জিক্যাল অপারেশানের চেষ্টা করেছে। ইউনাইটেড হাসপাতালে তো রোগীকে পুড়িয়ে মেরে স্বর্গে বিল পাঠানো হয় ‘পোড়ানোর খরচ’ শোধ দিতে। এরকম সমাজে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে এটা মার্সি কিলিং সার্ভিসের মতো।

আমাদের সমাজের অত্যন্ত সৎ মানুষেরা, করোনা পজিটিভ সার্টিফিকেট দিয়ে সরকারের ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে রাজসিক হাসপাতালে দলে দলে যায়। প্রবাস থেকে কোনো করোনাভাইরাস বিতরণে আসা অত্যন্ত সৎ লোকেরা রাজসিক হাসপাতাল খুঁজে বের করে –কিং সিস্টেমের চিপায়। নিয়ে নেয় করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট। ইতালিতে পৌঁছে যারা, করোনাভাইরাস বোমা ভর্তি বাংলাদেশ বিমান সম্মাননা এনে দিলো দেশের জন্য। কতো যে দেশেরে ভালোবাসে তারা; তা যদি তুমি জানতে।

করোনাকালে ক্রসফায়ার থিয়েটার বন্ধ; তাই এলিট থিয়েটার দলকে ন্যায়বিচারের নতুন নাটকের প্লট খুঁজতে হয়। স্বাস্থ্যখাতের ‘রুই কাতলা কাছিমের’ সমালোচনা ৫৭ ধারার দড়ি দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে দড়ি কম পড়েছে। পাটকল বন্ধ যে; দড়ি আসবে কোথা থেকে।

তাই ‘হলুদ সাহেদ কালো RAB’‍ ফেসবুক নাটক মঞ্চায়ন হলে; যথাযথ আতশবাজিতে ঈদুল সাহেদ উদযাপিত হয়। ভাবতে পারেন; ১৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ৯৯৯ জন সৎ মানুষের দেশে একটি অসত সাহেদ। পারলে বিরিয়ানির ডেকচি নিয়ে শেয়ালেরা শাহবাগে নেমে পড়ে; ফাঁসি চাই; ফাঁসি চাই; সাহেদের ফাঁসি চাই।

সাহেদ আসলে যে জোকার; সে এইসব শাসক শোষক পরিতোষক ভ্রান্ত নীতিধারক, ঠোঁট সেবার পাপিয়া, টেকাটুকা সেবার পাপলু, ‘সাতে পাঁচে থাকি না’ দাদা, ‘দুইটা চোখ দেখবা, দুইডা কান শুনবা; একটা মুখ তো কম কথা’ ভাইয়া; হাওয়া-চেতনা-বিপদের বাঁশী ভবনের সুচিন্তক; হেফাজাতক-জামাতক-ওলামা-কেরামত সবার মুখমণ্ডল জুড়ে অসত সাহেদের মুখোশ পরিয়ে দিয়ে; জোকারের মতো কান্নার সময় অট্টহাসিতে সাহেদ বলে, ক্যাচ মি; ইফ ইউ ক্যান।