এমপিওভুক্ত কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকের বেতন নেই ২৮ বছর

জুন ১১, ২০২০

একই কলেজের ডিগ্রি স্তরের শিক্ষকরা বেতনসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলেও অনার্স-মাস্টার্স নন-এমপিও স্তরের শিক্ষকরা তা পান না। দেশের ৩১৫টি এমপিওভুক্ত কলেজের প্রায় ৪ হাজার শিক্ষক বিগত ২৮ বছর ধরে এই বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

জেলা শহর ও উপজেলা সদরের কলেজগুলোতে টিউশন ফি থেকে এসব শিক্ষকদের যৎসামান্য বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। আর জেলা ও উপজেলা সদরের বাইরের কলেজগুলোয় প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও বেতন-ভাতা দেওয়া হয় না। পরীক্ষা এবং ভর্তির সময় খরচ বাবদ কিছু টাকা দেওয়া হলেও বছরের আর কোনও সময়ই কোনও অর্থ পান না তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের এসব শিক্ষকের সংসার চলে টিউশনি করে। এছাড়া আর্থিক যৎসামান্য সামর্থ্য নিয়ে অনেকেই ছোট ব্যবসা করেও সংসার চালান। মফস্বলের অনেক কলেজের শিক্ষকরা যাদের সামান্য জায়গা-জমি রয়েছে তারা সেখানে বাড়তি পরিশ্রম দিয়ে সংসার খরচের দায় মেটান। বছরের পর বছর তাদের এভাবে চললেও নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে করোনার এই মহাদুর্যোগের সময়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জনবল কাঠামো অনুযায়ী ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত পরিচালিত এমপিওভুক্ত কলেজগুলোয় ১৯৯৩ সালে অনার্স-মাস্টার্সের অনুমোদন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিধিবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত স্কেলে শিক্ষকদের মূল বেতন দেওয়ার শর্তে অনার্স-মাস্টার্সের বিষয় অনুমোদন নেয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কলেজের টিউশন ফি থেকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এই পর্যায়ে কলেজগুলোর জনবল কাঠামোতে স্থান পায় না অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের পদ। ফলে সরকারি বিধিবিধানের আলোকে এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ বঞ্চিত হন তারা।

দেশের ৫ শতাধিক কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। তবে গত কয়েক বছরে দুই শতাধিক কলেজ জাতীয়করণ করে সরকার। বাকি থাকে ৩১৫টি কলেজ।

এই পরিস্থিতি উত্তরণে বিষয়টি অবহিত করা হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৬ সালের জুন মাসে দেশের বেসরকারি সব অনার্স-মাস্টার্স কলেজগুলোর অধ্যক্ষ এবং গভর্নিং বডির সভাপতিকে বেতন-ভাতা ঠিকমতো দেওয়ার নির্দেশনা দেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। এ অবস্থায় বিকল্প খুঁজতে থাকেন শিক্ষকরা।

শিক্ষকরা সংগঠনের ব্যানারে এমপিওভুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। কলেজের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিওভুক্তির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানাতে থাকেন তারা।

শিক্ষকরা তাদের দাবি তুলে ধরে বলেন, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণে রাজধানীর বাইরের কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নারী। প্রতি পাঁচ বছরে ৪ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন ৩১৫টি কলেজ থেকে। দেশে নারী শিক্ষার উন্নয়ন ও মানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষায় বৈষম্য দূর করার দাবি জানান শিক্ষক নেতারা।

এসব পরিস্থিতির একপর্যায়ে কলেজের জনবল কাঠামোতে এই স্তরের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির জন্য ২০১৭ সালে হাইকোর্টে মামলা রিট করেন কুড়িগ্রাম জেলার মহিলা আদর্শ ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক হারুন-অর-রশিদ ও অন্যান্য শিক্ষকরা। হাইকোর্টে বেতন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্তির আদেশ দিলে সরকার পক্ষ আপিল করে। আপিল আদেশে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের এই নির্দেশনার পর বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেন-দরবার করে বাংলাদেশ নিগৃহীত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক পরিষদ। কিন্তু গত দেড় বছরেও কোন কার্যক্রম নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

বাংলাদেশ নিগৃহীত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক পরিষদের সভাপতি ইমদাদুল হক মিলন (ভারপ্রাপ্ত) বলেন, ‘এমপিওভুক্ত অনার্স-মাস্টার্স কলেজ ছিল ৫০০টি। গত কয়েক বছরে নতুন করে দুই শতাধিক কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। বাকি রয়েছে ৩১৫টি কলেজ। এসব কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের নন-এমপিও শিক্ষকরা ২৮ বছর ধরে সরকারি কোনও সুযোগ সুবিধা পান না।

ইমদাদুল হক মিলন আরও বলেন, আমাদের দাবি মুজিববর্ষে এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হোক। এসডিজি-৪ বাস্তবায়নের জন্য যখন আমরা লড়াই করছি, তখন উচ্চশিক্ষায় এই বৈষম্য দুঃখজনক। চার হাজার শিক্ষকের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। শিক্ষকদের পক্ষে আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

বাংলাদেশ নিগৃহীত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিল্টন রায় বলেন, ‘একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে ডিগ্রি স্তরের শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হয়েছেন। আর আমরা সরকারি কোনও সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি না। শহরের কয়েকটি কলেজ শিক্ষকদের বেতন দিলেও প্রায় সব কলেজই ঠিকমতো বেতন দেয় না। কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষক হয়েও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কাছে আমাদের হেয় হতে হয়। এই পরিস্থিতি মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত হওয়ার পথে অন্তরায়। আমরা কলেজগুলোর জাতীয়করণ চাই। আর জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত দ্রুত জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এখন একমাত্র ভরসা প্রধানমন্ত্রী।’

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শায়েদুল খবির চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা নেবো।