করোনার বিস্তার রোধে সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

এপ্রিল ২১, ২০২০

জেলায় জেলায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যাতে না বাড়ে, সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য তিনি জেলা প্রশাসনের সব কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা যাতে না বাড়ে, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজেদের সুরক্ষার পাশাপাশি জেলার মানুষদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী সোমবার (২০ এপ্রিল) ঢাকা বিভাগের চারটি জেলা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের সব জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়কালে এ নির্দেশনা দেন।

প্রধানমন্ত্রী ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এসব জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, স্বাস্থ্য বিভাগসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কতদিন চলবে তা বলা যায় না। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি স্থবির। জাতিসংঘসহ সবাই বলছে, সারাবিশ্বে একটি অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে। সে কারণে আমরা তিন বছর মেয়াদি প্রণোদনা দিয়েছি।’

ময়মনসিংহ জেলায় এ পর্যন্ত ২১ জন করোনা পজিটিভ উল্লেখ করে জেলাটির সঙ্গে মতবিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ পর্যন্ত এই জেলায় ২১ জন শনাক্ত হয়েছে। এটি একটি বড় জেলা। রোগী আর যাতে না বাড়ে সেদিকে সবাইকে নজর দিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার সঙ্গে একটি বড় জেলা। এ হিসাবে বলবো, আমাদের এখানে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। আপনার নির্দেশিত ৩১ দফা আমরা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করতে সক্ষম হয়েছি বিধায় আমরা এই পরিস্থিতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।’

শেরপুর জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ জেলাটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা মোটামুটি কম আছে। রোগী আর যাতে না বাড়ে—এই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে।’

প্রসঙ্গত শেরপুর জেলায় এ পর্যন্ত ১৭ জন সংক্রমিত হয়েছে।

নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় কালে তিনি বলেন, ‘ওএমএসের চাল দেওয়ার জন্য আমরা যে তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছি, সেই তালিকাটা যেন যথাযথ হয়। যারা দুস্থ ও যাদের প্রয়োজন তারা যেন পায়। যারা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সামাজিক সুরক্ষার অন্যান্য ভাতা পাচ্ছে, তাদের নাম তালিকায় থাকবে না। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যাতে না বাড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।’

কিশোরগঞ্জে করোনা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি উল্লেখ করে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই ভাইরাসটা যাতে আর না ছড়ায় সেটা দেখতে হবে। প্রত্যেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের বলবো—যার যার নিজের এলাকা সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা নেবেন।’

ওএমএস কার্যক্রম চলমান আছে উল্লেখ করে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওএমএস বন্ধ হয়নি। ওএমএস চলছে। কেবলমাত্র অতিরিক্ত যেটা দেওয়ার কথা তার তালিকা করার জন্য বলা হয়েছে। তালিকাটা এখনও হয়নি। এটা নিয়ে নানা সমস্যা দেখা দেওয়ায় আমরা তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছি। প্রত্যেকটি এলাকা থেকে যারা সত্যিকার অর্থে পাওয়া উচিত, তাদের থাকা উচিত। কারণ, ট্রাকে চাল দিলে লাইন দিয়ে লোক দাঁড়ায়। এখান থেকে যে যার মতো ইচ্ছা করে কিনে নিয়ে আবার সেগুলো বিক্রি করে। এগুলোর জন্য তো আমরা ওএমএস দেইনি। ওএমএস দেওয়া হচ্ছে তাদের জন্য, যারা হাত পেতে চলতে পারবে না, কিনতে পারবে না। এই সমস্যাগুলো দেখেই এগুলো বন্ধ করে তালিকা করতে বলেছি।’

এর আগে জেলার করোনা পরিস্থিতি তুলে ধরে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক সারওয়ার জাহান মুর্শিদ জানান, আমাদের এখানে বিদেশ থেকে প্রবাসীরা এলেও তাদের মাধ্যমে এখানে করোনাভাইরাস ছড়ায়নি। অতি সম্প্রতি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা রোগীদের মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছে।

তিনি বলেন, ‘৯৭ জন গতকাল (রবিবার) পর্যন্ত করোনা পজিটিভ। এদের মধ্যে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী ৪১ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।’

খাদ্য উদ্বৃত্ত এ জেলার চলতি বোরো মৌসুমের ধান কাটার সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ধান কাটার জন্য অন্য জেলার পাঁচ হাজার ৩৩২ জন শ্রমিক জেলায় কাজ করছে। স্থানীয় শ্রমিক ৫৫ হাজার ৭৬৮ জন, যারা করোনা পরিস্থিতির জন্য বেকার হয়ে গেছে। তাদের এবং সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ছেলেরা কাজ করছে। আশা করছি, বি আর ২৮ ধান ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কাটা সম্পন্ন করতে পারবো। বি আর ২৯ আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে কাটা শুরু হবে। সেটা হয়তো ১৫ মে’র মধ্যে শেষ হবে। ধান পাকলে আমরা সেখানে শ্রমিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে বেশি শ্রমিক লাগিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা করছি।’

ধান কাটার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগে থেকে বলা হয়েছিল হাওর অঞ্চলে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য আমি ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিয়েছিলাম—তোমরা সেখানে যাও। আমাদের ছাত্ররা নেমেছে। ওখানে যারা স্থানীয় আছে তাদের কাজে লাগানো। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী মাঠে গেলে উৎসাহিত হবে। যারা কাজ পাচ্ছেন না তাদের জন্য এখন একটা সুযোগ। ধান কাটতে গেলে তারা ধান পাবে আবার টাকাও পাবে। এখন যেহেতু কলকারখানা বন্ধ। কৃষি কাজটা এখন একটা সুযোগ। মানুষ ইচ্ছা করলে এই সুযোগটা এখন নিতে পারে।’

কিশোরগঞ্জে ওএমএসের চাল বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি উঠলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মানুষের প্রবণতা তো ভালো নয়। বরাদ্দ বাড়িয়ে দিলে পরে দেখা যাবে তারা কাজ করতে চাইবে না। বাড়িয়ে দেওয়া হলে ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, মানুষ একবেলা খেতে পারলে পরের বেলার চিন্তা করে না। ফলে যখন রিলিফ পাবে আর কাজ করবে না বসে থাকবে।’

কিশোরগঞ্জ রাষ্ট্রপতির জেলা

কিশোরগঞ্জের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে আলাপকালে ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্ত এ জেলায় কোনও রাইস মিল আছে কিনা তা জানতে চান প্রধানমন্ত্রী। জবাবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। এখন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কারণে জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ আসলে কিশোরী থেকে গেলো। এটিতো রাষ্ট্রপতির জেলা। এখানে স্বাধীনতার সময় উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ জেলায় জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এখনও এ জেলায় (আবদুল হামিদ) রাষ্ট্রপতি রয়েছেন। এজন্য মনে হয় এ জেলার মানুষ মনে করে আমাদের আর কী লাগবে আমরা তো রাষ্ট্রপতির জেলা।’

দরিদ্রদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য হোম কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন মেনে চলা খুবই কষ্টকর উল্লেখ করে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের সব অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষ একটি মাত্র কক্ষে রাত্রিযাপন করেন। তারা সবাই একটি মাত্র টয়লেট এবং একটি মাত্র গোসলখানা ব্যবহার করে। এসব পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে বা করোনার লক্ষণ দেখা দিলে, তারা সাধারণত তা গোপন করে রাখে। এই প্রেক্ষাপটে কীভাবে তারা হোম কোয়ারেন্টিন আইসোলেশন মেনে চলবেন, কীভাবে সোশ্যাল ডিসট্যান্স, ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন—এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান আরও জোরদার করা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলা ডেঞ্জার জোনে পরিণত হয়েছে। এসব জেলা থেকে আমাদের জেলার প্রবেশপথ কঠোরভাবে সিল করা হলে এবং মহাসড়কে চেকপোস্ট আরও জোরদার করা হলে করোনা বিস্তার রোধ করতে সক্ষম হবো।’

জেলা প্রশাসক জানান, জেলা থেকে ৬৮২ জন কৃষি শ্রমিককে ধান কাটার জন্য নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছে। কালিহাতী উপজেলায় ডিজিটাল স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করে চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। অন্যান্য উপজেলায় এটি শুরু করা হবে। এর ফলে এক ব্যক্তি একাধিকবার চাল নিতে পারবেন না। এই চাল বিতরণ কার্যক্রম অফিসে বসেই মনিটর করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে জাতির প্রতি আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। এছাড়া আমি আর কিছু নই এবং কিছু চাইও না। এই দুঃসময় থাকবে না, এই দুঃসময় আমরা একদিন কাটাতে পারবো।’

টাঙ্গাইলে এক টিম

সোমবার ভিডিও কনফারেন্সে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক তার জেলার করোনা রোগী সংক্রান্ত তথ্য উল্লেখ করেন। তিনি জানান, তার জেলায় বর্তমানে ১১ জন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে তিন জন ঢাকা থেকে, সাত জন নারায়ণগঞ্জ ও একজন গাজীপুর থেকে সংক্রমিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে রোগী কম থাকায় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেন। রোগীর সংখ্যা ১১ জন হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেট টিমের সদস্য সংখ্যার দিকে ইঙ্গিত করে হাসির ছলে বলেন ‘আপনারা একটা টিমে রেখে দিয়েছেন।’ এটা যাতে আর না বাড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।’

মানিকগঞ্জ সুস্থ আছে সুস্থ থাক

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা খুবই ভালো যে নিজেরা ব্যবস্থা নিয়েছেন। ভালো অবস্থাটা ধরে রাখতে হবে। তবে মানিকগঞ্জের সমস্যাটা ওই পাটুরিয়া ঘাট, সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মানিকগঞ্জকে সুরক্ষিত করতে পেরেছেন এজন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। মানিকগঞ্জ সুস্থ আছে, সুস্থ থাক।’

এ পর্যন্ত মানিকগঞ্জ জেলায় ৬ জন করোনাভাইরাস পজিটিভ বলে জেলা প্রশাসক জানান। প্রসঙ্গত, ঢাকার সঙ্গে সীমান্তবর্তী বা নিকটবর্তী জেলাগুলোতে তুলনামূলকভাবে করোনা প্রাদুর্ভাব বেশি। এদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। সেই হিসেবে ঢাকার কাছাকাছি জেলা হিসেবে মানিকগঞ্জে করোনা পজিটিভ সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক জানান, নিম্ন-মধ্যবিত্তদের যারা হাত পেতে খাবার নিতে লজ্জা পাচ্ছেন, তাদের টেলিফোন বা এসএমএসে সাড়া দিয়ে তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।