পরীক্ষা পদ্ধতি-প্রশিক্ষণ বিফলে, ভরসা অনুশীলন বই

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০

সৃজনশীল প্রশ্নপত্র পদ্ধতির প্রশিক্ষণ ও পাবলিক পরীক্ষা সংস্কার পদ্ধতি বিফলে যাচ্ছে। পাঁচ বছরে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির বিষয়ে ৯ লাখ ২৬ হাজার শিক্ষক ও কর্মকর্তা দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ পেলেও এর সুফল মিলছে না। এমনকি সৃজনশীল পাঠদানে শিক্ষকদের অদক্ষতার কারণে নির্ভর করতে হচ্ছে অনুশীলন বইয়ের ওপর। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, অনুশীলন বই ভরসা। এটি বন্ধ করে দেওয়া হলে হুমকির মুখে পড়বে লেখাপড়ার মান।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সৃজনশীল প্রশ্নপত্র পদ্ধতির প্রশিক্ষণ ও পাবলিক পরীক্ষা সংস্কার পদ্ধতি জন্য বিভিন্ন কাজে পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তারপরও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে এখনও নির্ভর করতে হচ্ছে অনুশীলনমূলক বইয়ের নির্ভরশীল থাকছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। আবার পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার ও উন্নয়নে ১৬৪ জন কর্মী নিয়োজিত থাকলেও পরীক্ষায় অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেসব শিক্ষক-কর্মকর্তা শিক্ষা সহয়াক বই বা নোট-গাইড বই প্রণয়ন এবং কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তাদের অনেকেই আবার পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব পাচ্ছেন। এতে বারবার পাবলিক পরীক্ষায় বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। নোট-গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন পাবলিক পরীক্ষাও দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা দায়ি হলেও দোষ গিয়ে পড়ছে অনুশীলনমূলক বই প্রণয়নকারীর ওপর। 

চলমান এসএসসি ও সমপর্যায়ের পরীক্ষায় এমসিকিউ প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণ ও পুরোনো প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া, যথাসময়ে প্রশ্নপত্র বিতরণ করতে না পারা, পরীক্ষার সময় বাড়ানো ও কমানো এবং খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া অনুশীলন বইয়ের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়াসহ নানা রকম বিশৃঙ্খলা ঘটছে। যদিও অনুশীলনমূলক বই প্রণয়নকারীরা বলছেন বিগত বছরের প্রশ্নের সঙ্গে মিলেছে ২০২০ সালেরে এসএসসির একটি প্রশ্ন। তাদের দাবি বিগত সময়ের বোর্ডের প্রশ্নের অনুকরণেই দু-একটি প্রশ্ন নির্বাচন করেছেন অনুশীলন গাইড বই প্রণেতারা। অথচ এ নিয়ে শুধুই জলঘোলা করা হচ্ছে। 

এই বিষয়টি মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্র সচিবদের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে পরীক্ষা কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে পুরোনো প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও ২০/২৫ মিনিট পরীক্ষা নিয়ে নতুন করে প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হচ্ছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্রশ্ন প্রণেতা অর্থাৎ শিক্ষক নির্বাচনে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলতিই এর জন্য দায়ী। তারা ভালোভাবে যাচাই বাছাই না করেই প্রশ্নপ্রণেতার তালিকা করছেন। শিক্ষকরা অদক্ষতার কারণে অনুশীলন বই থেকে প্রশ্ন প্রণয়ণে সহায়তা নিচ্ছেন। এ দায় অনুশীলন বই প্রণেতাদের নয়। এছাড়া কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকরা তারাও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব পাচ্ছেন।’

এদিকে, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় নানা রকম বিশৃঙ্খলার প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়নে বিগত সময়ে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এর হিসাব চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর জবাবে মন্ত্রণালয়ে একাধিক প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে ‘সেসিপ’ থেকে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় সেসিপ বাস্তবায়ন হচ্ছে।

সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (সেসিপ) আওতায়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারাদেশের ৯ লাখ ২৫ হাজার ৫৭২ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে কারিকুলামে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সৃজনশীল বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৬৯০ জনকে, যাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা।

সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের ওপর দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ সংক্রান্ত শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, ৬৪০টি আইসিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপন, ২০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শিক্ষা উপকরণ বিতরণ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ১০০টি স্কুল-মাদ্রাসায় অতিরিক্ত শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে দুই হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

এছাড়াও বিদ্যালয় মনিটরিং ‘সুপারভিশন’ কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে সারাদেশের এক হাজার ১৪১ জন জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চারটি মেট্রোপলিটন শহরে ২৫টি নতুন থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস স্থাপন করা হয়েছে।

সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি

২০১০ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে এসএসসি/দাখিল এবং এইচএসসি/আলিম পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি প্রবর্তন ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ এর একটি অন্যতম কর্মসূচি। ২০১৭ সালে এসএসসি/দাখিল এবং এইচএসসি/আলিম পরীক্ষায় নির্ধারিত সব বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালুর মাধ্যমে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রাথমিক পর্যায় সপ্তাহ হয়। পরবর্তীতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কারও সম্পন্ন হয়।

এ ব্যাপারে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘আসলে মানসম্মত প্রশিক্ষণ হয়নি। নামমাত্র ৫/৭ দিন সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের কোয়ান্টিটির (পরিমাণগত) ওপর জোর দিয়ে প্রকল্প শেষ করা হচ্ছে, ঋণের টাকা-পয়সা ব্যয় করা হচ্ছে, ভ্রমণ বিলাস হচ্ছে; কিন্তু কোয়ালিটি ইম্প্রুভ (গুণগত মানোন্নয়ন) করেনি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্ন প্রণেতা, শিক্ষক ও মাস্টার ট্রেইনারের চেয়ে নোট-গাইড প্রণেতা ও কোচিং সেন্টারের ব্যক্তিরাই বেশি দক্ষ। এর ফলে সৃজনশীল বিষয় যে উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছিল তা ফলপ্রসূ হয়নি।’

পরীক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে অপচয়

বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার সংস্কার, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করাসহ এ সংক্রান্ত প্রয়োজনে ২০১৫ সালে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট’ (বেডু)। কিন্তু এই ইউনিটের কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক কোন প্রভাব পরছে না পাবলিক পরীক্ষায়।

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় এক শ্রেণীর শিক্ষকের দুর্নীতির মনোভাব ও গাফিলতির কারণে অধিকাংশ পরীক্ষায় বড় ধরনের মাশুল দিতে হচ্ছে পরীক্ষার্থীদের। কেন্দ্রে নতুন ও পুরনো সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন বিতরণে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। কোথাও কোথাও ইচ্ছেমতো পরীক্ষার সময় বাড়ানো ও কমানোও হচ্ছে। ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায়ও এই ধরণের বিশৃঙ্খলা ছিল। গত বছর শতাধিক কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল।

এক সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় একাধিকবার পরীক্ষা স্থগিত বা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল শিক্ষা প্রশাসন। যদিও ২০১৮ সালে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে প্রশ্নফাঁস। কিন্তু এবার এসএসসি পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় বিস্তর ত্রুটির প্রমাণ মিলছে, যার প্রভাবে গলদঘর্ম অবস্থায় রয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র সচিবকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েই কর্তব্য শেষ করছে শিক্ষা বিভাগ।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, ভর্তিসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই গ্রেফতার হয় ১৯০ জন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের’ নামে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের টাকা খরচ দেখানো হলেও কার্যত এই ইউনিটের কোন জবাবদিহিতা নেই। তারা শিক্ষকদের কি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, কি শেখাচ্ছেন; আর কি উন্নতি হলো তা জানার কোন উপায় নেই। এ ইউনিট থেকে ট্রেনিং ম্যানুয়াল ছাপা হয়। প্রশিক্ষণে ডাকা হয়। কিন্তু প্রশ্ন তৈরি, মডারেশন, কেন্দ্র ইত্যাদি নির্ধারণের সময় স্বজনপ্রীতি বা বিনিময়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে প্রশিক্ষণ কোন কাজে আসে না বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষকদের।