দুর্নীতির মর্যাদা||মাসকাওয়াথ আহসান||

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০

পরিশ্রম করে বোকা লোকেরা। তারা খেটে মরে। সংসার চালাতে বিপর্যস্ত হয়। আর চালাক লোকেরা দেশপ্রেম করে, ধর্মপ্রেম করে, কোনটি হারাম-কোনটি হালাল তা নির্ধারণ করতে করতে একসময় ‘হালাল স্বৈরাচার’ চিহ্নিত করে একটি ছাতা নিয়ে হাজির হয়ে যায় স্বৈরাচারির মাথা খররৌদ্র থেকে বাঁচাতে।

আজ সমাজে বেকার সমস্যা এক তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর কারণ আর কিছুই নয়; আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে তুলতে পারিনি। মনীষী হরলাল রায় প্রণীত বাংলা রচনা গ্রন্থে ‘শ্রমের মর্যাদা’ বিষয়ে রচনা পাঠ করে আমরা দিকভ্রান্ত হয়েছি। মনীষী কার্লাইলের মতো সততা আর নৈতিকতার ভাইরাস আক্রান্ত যে লোকেরা সমাজে আছেন, তারা পরিশ্রমকেই সৌভাগ্যের প্রসূতি বলে মনে করেন। এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের কবলে পড়ে বেশির ভাগ মানুষই জিডিপির জ্যামিতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি মনীষী পিকে হালদারের লেখা ‘দুর্নীতির মর্যাদা’ প্রবন্ধে আমরা দেখতে পাই; পদ্মা নদীর মাঝি কুবের নদীর মাছ ধরে তার শ্রমের মর্যাদা না পেলেও; পিকে মাঝি ব্যাংকের টাকার মাছ ধরে তার দুর্নীতির মর্যাদা লাভ করেছেন। তিনি তার নতুন যুগোপযোগী বর্ণমালা শিক্ষার মাধ্যমে ‘ব’তে বাংলাদেশের ‘ট’-তে টাকার মাছ ধরে ‘ভ’-তে ভারত ও ‘ক’-তে ক্যানাডায় ‘প’-তে পাচার করেছেন।

‘দুর্নীতি’র মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় দেশে-বিদেশে নিরলস কাজ করে চলেছেন এমন অসংখ্য গুণী মিডলম্যান। শ্রমের মর্যাদার আলেয়ায় খাবি খাওয়া আউটডেটেড লোকেদের মিডল ফিঙ্গার প্রদর্শন করে মিডলম্যানেরাই আজকের সাফল্যের রোল মডেল।

সব রাজনীতিকই দুর্নীতিবাজ নন; তবে সব রাজনীতিকই দুর্নীতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মিডলম্যান। সৎ রাজনীতিকদের দুস্থ হয়ে পড়ার ট্র্যাজেডিতে শ্রমের মর্যাদার অবাস্তব দিকগুলো ফুটে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়, সৎ কর্মীদের মূল্যায়ন হলো না বলে। আসলে দুর্নীতির মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকায় তারা সম্পদ ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারলেন না।

দুর্নীতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কুস্তিকলা, চৌর্যশৈলী, তৈলকার্যে দক্ষতা অর্জন বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। দুর্নীতির মূলধন হিসেবে অতি ‘দেশপ্রেম’ ও অতি ‘ধর্মপ্রেম’ চর্চা বাঞ্চনীয়। সবচেয়ে যেটা বেশি প্রয়োজন তা হলো, তীব্র অনুভূতির কামড়। শরীরের মধ্যে অনুভূতির প্রাবল্যকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে; যাতে অনুভূতিতে সামান্য আঘাত লাগলেই গলা ছেড়ে আদিম হাঁক মারার অভ্যাস গড়ে ওঠে।

‘শ্রমের মর্যাদা’ অত্যন্ত ভ্রান্ত পাশ্চাত্য শিক্ষা। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাতিকে ইউরোপের দেশগুলো ‘শ্রমের মর্যাদা’ দিতে গিয়ে ‘সাফল্য’, ‘গৌরব’, ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ এসব শব্দের সঙ্গে একেবারেই পরিচিত হতে পারেনি।

অথচ ভারতীয় উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া ‘দুর্নীতির মর্যাদা’ দিয়ে সাফল্যের মুকুটে শ্রেষ্ঠত্বের পালকের গৌরবে পেট ফেটে মরার দশা হয়েছে। প্রাচ্যে বসে প্রতীচ্যের ‘শ্রমের মর্যাদা’ চর্চা মানেই ফেসবুকে মৃত্যু-বিছানায় অশ্রুসিক্ত অচল গুণীজনের ছবি। মিডলম্যানদের করুণা বিতরণের অপার সুযোগ। ‘মিডলম্যান’ অমুক শিল্পীর চিকিৎসা্র দায়িত্ব নিলেন, ‘মিডলম্যান’ সদ্য প্রয়াত তমুক মনীষীর পরিবারের খরচে নির্বাহের দায়িত্ব নিলেন জাতীয় সংবাদ। যা ‘দুর্নীতির মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠার অন্যতম নিয়ামক।

দুর্নীতির প্রধান চালিকা শক্তি সোনালী স্বৈরাচার। দুর্নীতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাই শ্রমের মর্যাদার আকাংক্ষা প্রসূত ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’কে দুর্নীতির মর্যাদাঘন ‘স্বৈরাচার দে বসন্ত’ দিবসে রূপান্তরিত করতে হবে।

মিডলম্যানদের চিন্তাসূত্র, “স্বৈরাচারেরে ভালোবাসিলাম”; সাফল্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবমণ্ডিত জীবন নিশ্চিত করতে পারে। প্রলেতারিয়েতের পলিটিক্যাল এলিট হবার একটাই পথ; স্বৈরাচারেরে ভালোবাসিলাম। মিডলম্যানই দুর্নীতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাঝ দিয়ে কালক্রমে পলিটিক্যাল এলিটে পরিণত হয়।

পরিশ্রম করে বোকা লোকেরা। তারা খেটে মরে। সংসার চালাতে বিপর্যস্ত হয়। আর চালাক লোকেরা দেশপ্রেম করে, ধর্মপ্রেম করে, কোনটি হারাম-কোনটি হালাল তা নির্ধারণ করতে করতে একসময় ‘হালাল স্বৈরাচার’ চিহ্নিত করে একটি ছাতা নিয়ে হাজির হয়ে যায় স্বৈরাচারির মাথা খররৌদ্র থেকে বাঁচাতে।

সমাজের অধিকাংশ মানুষই যেহেতু সেইসব বাতিল শব্দ ‘সততা’, ‘শ্রমের মর্যাদা’ এগুলো শুনতে পছন্দ করে; তাই তাদের কানের তুষ্টির জন্য পরিচালিত দুর্নীতি বিরোধী অভিযান দেখে ভয় পেলে চলবে না। যাত্রার বিবেকের গান শুনে বিচলিত হবার কোন কারণই নেই। মিডলম্যানের জীবন বীরের জীবন; ধরা পড়লে কারাগারের আরামদায়ক জীবন, ধরা না পড়লে পশ্চিমের আরো আরামদায়ক সেকেন্ড হোম।

দক্ষিণ এশিয়ার নানাদেশের ‘দুর্নীতির মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠাকারীদের আলিশান ‘সেকেন্ড হোম’ দেখে পশ্চিমের ‘শ্রমের মর্যাদা’র বাতিকওয়ালারা শীঘ্রই বুঝতে পারবে; মনীষী কার্লাইল তাদের কীরকম ধোকা দিয়েছে। ইউরোপ, এমেরিকা, ক্যানাডায় সারাজীবন পরিশ্রম করে জীবনের যে প্রবৃদ্ধি হয়; তার চেয়ে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটে দক্ষিণ এশিয়ার দুর্নীতির মর্যাদা স্বর্গগুলোতে।

হালে দুর্নীতির মর্যাদার একটি শিল্পিত দিকও উন্মোচিত হয়েছে। মিডলম্যানদের দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেমানুভূতি বেচাকেনার হাটে নতুন চমক, মিডলম্যানদের লেখা গ্রন্থ প্রকাশ। বাড়ি-গাড়ি-ভুঁড়ি সবই যখন হয়েছে; তখন সে সুকৃতিকে শিল্পিত রূপ দিতে গ্রন্থপ্রকাশ অত্যন্ত জরুরি। সে গ্রন্থ মোটিভেশনাল আত্মজীবনী হতে পারে,
বিশ্বজয়ের ভ্রমণকাহিনী হতে পারে, ইমোশনাল দেশপ্রেমমূলক হতে পারে,
সেন্টিমেন্টাল ধর্ম-প্রেমময় হতে পারে।

সুতরাং আর নয় শ্রমের মর্যাদার ভ্রান্তি; জীবন বিকশিত হোক দুর্নীতির মর্যাদার গৌরবে। দরকারি লোক নয়; কেবল সরকারি লোক হয়ে ওঠাই হোক আমাদের মহানব্রত।