কবি ও গায়ক শরিয়ত সরকারের মুক্তি চাই

জানুয়ারি ১৩, ২০২০

কে বা কারা ধর্মের ম্যানেজার হয়ে গিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলো যে, শরিয়ত সরকার ইসলাম ও মহানবীকে নিয়ে কটূক্তি করেছে; অমনি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আদালতে তুললো। আর আদালত তার জন্য পুলিশি রিমান্ডের ব্যবস্থা করলো। পুরো ব্যাপারটাই যেন অন্ধকার যুগের ঘটনাবলী। দুর্ভাগ্যক্রমে একবিংশ শতকের একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ঘটছে।

সৃষ্টিকর্তা তার প্রেরিত পুরুষদের সবাইকেই বিশেষ গুণ উপহার দিয়েছিলেন। স্রষ্টা তার প্রেরিত পুরুষ দাউদ (আঃ)-কে উপহার দিয়েছিলেন, সুর আর সংগীতের গুণ। স্রষ্টা যে গুণ তার প্রেরিত একজন প্রতিনিধিকে দিয়েছেন; তা কোনভাবেই ‘হারাম’ বা ‘নিষিদ্ধ’ হতে পারেনা।

এই গোটা সৃষ্টিজগতই নানা রকম সুর আর ছন্দে ভরপুর। সূর্যোদয়ে পাখির গানে-হাওয়ার সুর-নদী ও সমুদ্রের ঢেউয়ের কলকল শব্দে একটি আলোর দিনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

যা কিছু সুন্দর তা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। কাজেই সংগীতের সুন্দরকে নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার কারো নেই।

কবি গানের শিল্পী শরিয়ত সরকারকে ‘সংগীত ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ নয়’ এই অভিমত প্রকাশ করার অভিযোগে বাংলাদেশের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। আদালত তাকে রিমান্ড দিয়েছে। শিল্পী শরিয়তের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে স্বপ্রণোদিত ধর্মের ম্যানেজারেরা।

বাংলাদেশে ‘অভিমতের স্বাধীনতা’ কেড়ে নিতে ব্লাসফেমি আইনের আদলে তৈরি করা প্রথমে ৫৭ ধারা ও পরে ডিজিটাল আইনটি একবিংশ শতকের সঙ্গে মানানসই নয়। একটি আধুনিক রাষ্ট্র মধ্যযুগীয় কায়দায় মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে চলেছে; একের পর এক।

এই কালো আইন ধর্ম ও সরকারের ভাবমূর্তি পাহারা দেবার ব্যবস্থা করেছে। এই আইনটি ব্যবহার করে ধর্মের অনুভূতির ম্যানেজার ও সরকারের অনুভূতির ম্যানেজাররা ভিন্নমতপোষণকারীদের রাষ্ট্রের পুলিশ ও আদালতের পৃষ্ঠপোষকতায় কারাগারে নিক্ষেপ করে।

ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত নৈতিকতা চর্চার বিষয়। আল্লাহর সঙ্গে একজন মুসলমানের বা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে পৃথিবীর যে কোনো মানুষের সম্পর্কটি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এরকম আধ্যাত্মিক বা স্পিরিচুয়াল সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির নাক গলানো রীতিমত অপরাধ।

শরিয়ত সরকার একজন স্বভাব কবি ও গায়ক। এটি তার বিশেষ গুণ। এই গুণটি আর পাঁচটা মানুষের নেই। শরিয়ত সরকার সুরের মানুষ বলে; সংগীতের মাঝ দিয়ে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক যোগাযোগটি তৈরি করেন। কবি জালালুদ্দিন রুমি থেকে কবি ও গায়ক লালন ঠিক যেভাবে স্রষ্টাকে কাছে পেতে চেষ্টা করেছিলেন।

বাংলাদেশ নদীর দেশ। সৃষ্টির আদি থেকেই এখানে নৌকার নিঃসঙ্গ মাঝি গান গেয়ে সৃষ্টিজগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। কৃষক গান গেয়ে কৃষিকাজ করেন, শ্রমজীবী মানুষের রয়েছে নানারকম শ্রমের গান। প্রত্যন্তে গরুর গাড়ি চালানোর সময় গাড়িয়াল ভাইয়ের গান যেমন যাপিত জীবনেরই অংশ।

এই যাপিত জীবনে নৈতিকতা শিক্ষার জন্য মানুষ যার যে ধর্ম পছন্দ সেটা বেছে নিয়েছে। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খৃস্টান বা অন্যান্য ধর্ম বেছে নিয়েছে।

বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় রাজনীতিতে ‘ভোট ব্যাংক’ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে ইসলাম ধর্মের স্বপ্রণোদিত ম্যানেজারদের পৃষ্ঠপোষকতা করে রাজনীতির লোকেরা। অথচ ধর্মের ম্যানেজারি বিষয়টিই বে-আইনি। মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে বে-আইনি হস্তক্ষেপের এই সুযোগ রাষ্ট্রই তৈরি করে দিয়েছে রীতিমত আইন করে।

ধর্ম একেবারেই স্বেচ্ছাসেবার বিষয়। ধর্মীয় স্বেচ্ছাসেবার সঙ্গে রুটি-রুজির সম্পর্ক তৈরি মানেই; ধর্মকে পণ্য করে ফেলা। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ধর্ম-ব্যবসা যে হারাম বা নিষিদ্ধ এটা তো কমনসেন্সের বিষয়। সরকারি দলের ম্যানেজার হয়ে চাঁদা তুলে বেড়ানো যেমন বে-আইনি কাজ; ধর্মের ম্যানেজার হয়ে চাঁদা তুলে বেড়ানো ঠিক তেমনি বে-আইনি কাজ।

ইসলামে বিতর্ক বা বাহায বহু চর্চিত একটি বিষয়। বিতর্ক যেহেতু সভ্যতার সেতুবন্ধ; তাই ধর্ম-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ভিন্নমতের বিতর্ক উত্থাপিত হলে; উভয় অভিমতের মানুষের মাঝে বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করাটাই সভ্যতার চর্চা।

শরিয়ত সরকার যেহেতু কবির লড়াই করেন; সেটাও তো লোকজ বিতর্ক আঙ্গিক। নানা বিষয় নিয়ে দুটো পক্ষ গানের সুরে সুরে ছন্দ মিলিয়ে কবির লড়াই করে। এ হচ্ছে প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য।

সেই ঐতিহ্য চর্চার মাঝে কালো-আইনের পেশীর ব্যবহার অত্যন্ত আদিম এক আচরণ। কে বা কারা ধর্মের ম্যানেজার হয়ে গিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলো যে, শরিয়ত সরকার ইসলাম ও মহানবীকে নিয়ে কটূক্তি করেছে; অমনি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আদালতে তুললো। আর আদালত তার জন্য পুলিশি রিমান্ডের ব্যবস্থা করলো। পুরো ব্যাপারটাই যেন অন্ধকার যুগের ঘটনাবলী। দুর্ভাগ্যক্রমে একবিংশ শতকের একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ঘটছে।

কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার দলীয় ম্যানেজাররা গিয়ে অভিযোগ দেয়, ‘অমুক’ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর নামে কটূক্তি করেছে । তখন একই রকম দৃশ্যের অবমাননা হয়।

ফ্যাশিজম বা স্বৈরফইন্নিবাদ এইভাবে ধর্ম ও রাজনীতির দরিদ্র ও ভিক্ষুক ফুটসোলজারদের কালো-আইন আর পুলিশ-আদালতের সমর্থন দিয়ে ভরণ-পোষণ করে।

শরিয়ত সরকারের শীঘ্রই মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। একজন কবিগানের বিতার্কিকের অভিমত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেবার অধিকার কারো নেই। কারো তার সঙ্গে ভিন্নমত থাকলে গিয়ে কবির লড়াই করুন। চিন্তার দ্বন্দ্বের মধ্যে থানা-পুলিশ ডেকে আনাটা একটা অসভ্য আচরণ।

অযাচিত ম্যানেজারেরা যে চিন্তার পাতকুয়ায় বসবাস করে; ওটাই তো পৃথিবী নয়। মির্জাপুরের কোন ধর্মের ম্যানেজারের মনে হলো যে শরিয়ত সরকার ধর্মের অবমাননা করেছেন; আর অমনি পুলিশ তাকে বেঁধে নিয়ে গেলো; এ হচ্ছে জবরদস্তি। ধর্ম সৃষ্টিকর্তা আর সৃষ্টিজগতের প্রতি একান্ত ভালোবাসার বিষয়।

আর সৃষ্টিকর্তা বা তার ধর্ম বা প্রেরিত পুরুষের ইমেজ এতো দুর্বল নয়; যে মির্জাপুরের দুটি ধর্মের ম্যানেজার লাগবে; তাদের রক্ষা করতে। এক চড়ুই পা দুটো উপর দিকে তুলে শুয়ে ছিলো; আরেক চড়ুই তাকে জিজ্ঞেস করে, পা তুলে শুয়ে আছিস কেন; নামিয়ে শো আরাম লাগবে। পা ওপরে তোলা চড়ুই বলে, পা দুটো দিয়ে আকাশের ভেঙ্গে পড়া ঠেকিয়ে রেখেছি; পা নামালেই ভেঙ্গে পড়বে।