‌‘বাতেন’ কিংবা ‌‘রঞ্জিত’ থেকে সাহেব ও বাবু

ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯

এখন নুরকে যারা নুরা বলে ডাকছে; বা বাবু ও সাহেবদের কায়দায় ‘ছোট’ করতে চেষ্টা করছে; এদের পোশাক-খাদ্যরুচি-লাইফ স্টাইল-বাচনিক সক্রিয়তা-সাংস্কৃতিক সূচক; এগুলো মোটামুটি গত দশবছরে সবার চোখের সামনে পরিবর্তিত হয়েছে; ফেসবুক থাকায় এই রূপান্তর বা মেটামরফসিস রীতিমত আর্কাইভড হয়ে আছে। এদের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের গড় সাংস্কৃতিক মানটিও যে কোন সমাজবিজ্ঞানী খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে। দল ক্ষমতায় আসায় উপার্জন বাড়ায়; এরা সেই কাছা মেরে ডানকিনে মাছ ধরা ‘বাতেন’ কিংবা ‘রঞ্জিত’ থেকে আজ এতো সাহেব ও বাবু হয়েছে যে, নুরকে ‘ছোট’ করতে নুরা বলে ডাকছে। তারা কথায় কথায় ঘৃণা প্রকাশ করছে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি নুর ও তার সতীর্থদের ওপর হামলার পর; এই হামলা সমর্থন করে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অসংখ্য বক্তব্য দৃশ্যমান হয়েছে।

দশ বছর ধরে ক্ষমতাকাঠামোর ধারে-কাছে থেকে একটু ‘পলিটিক্যাল এলিট’ হয়ে উঠে প্রতিমূহূর্তে ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকে রজ্জুতে সর্পভ্রমের মতো ‘নুর’-কে নিয়ে অহেতুক শংকা পরিলক্ষিত হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মাঝে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ডাকসুর কোন ভিপিকে পরবর্তী জীবনে রাজনীতিতে সফল হতে দেখিনি। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা নেতৃত্বের চেয়ে বিপুল ধন-সম্পদ তৈরি করা ব্যবসায়ীদের জাতীয় নেতা বানানোর প্রবণতা খুব স্পষ্ট বড় বড় রাজনৈতিক দলে। কাজেই নুর কালক্রমে ভারতের মতো নতুন জননেতা কানহাইয়া বা কেজরিওয়াল হয়ে উঠবে; এরকম চিন্তা-ভাবনা কল্পনাপ্রসূত ও প্যারানয়াগ্রস্ত।

নুর সংক্রান্ত আলোচনায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা তার উপর হামলাকে যেভাবে সমর্থন জানিয়েছেন; তা খুনে মানসিকতা ও নরমাংসভক্ষণের লোভের সূচক। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের সমাজের বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্যানিবাল হয়ে উঠেছে; এটা গভীর আশংকাজনক ব্যাপার। যে কোন সুস্থ মানুষ চাইবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেন খুনোখুনির অপ- সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পরস্পরের প্রাণঘাতী না হয়। নুর ও তার বন্ধুরাই হোক কিংবা ছাত্রলীগই হোক; বয়সে এরা নবীন। এদের সংঘর্ষ বন্ধের চেষ্টাই অপেক্ষাকৃত বয়েসীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত।

নুরের ওপর হামলা সমর্থনকারী ক্যানিবালদের আরেকটি মানসিক রোগের লক্ষণ সুস্পষ্ট। লক্ষ্য করলাম, আওয়ামী লীগের সমর্থকরা, নুরকে, গেরাইম্মা-গরীব-শিবির-এরকম ইনফেরিওরিটির যতরকম অশ্লীল তকমা তা দিয়ে, নুরা বলে ডাকছে। এই যে সুপিরিওরিটি দেখানোর মানসিক রোগ, এটা ১৯৪৭ সাল এর আগে স্বদেশী জমিদার আর ১৯৪৭ সালের পরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের জমিদারদের মাঝে দেখা গেছে। এ এক ভয়ংকর মনোবিকার-এই মনোবিকার যুগে যুগে যারাই প্রদর্শন করেছে; তারাই বিনাশ হয়ে গেছে।

অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতারা বেশ কিছুকাল ধরে ‘আওয়ামী লীগের বিশুদ্ধ রক্তে’-র আকাংক্ষাটি বেশ জোরে শোরে ব্যক্ত করেছেন। একাধিক্রমে তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘৪৭-এর আগের স্বদেশী জমিদার আর ‘৪৭-এর পরের পাঞ্জাবের জমিদারের উন্নাসিকতার রোগ ভর করেছে; এটা সুপষ্ট। এ রোগের উপশম না হলে তারা ভুগবেন; বলাই বাহুল্য।

এখন নুরকে যারা নুরা বলে ডাকছে; বা বাবু ও সাহেবদের কায়দায় ‘ছোট’ করতে চেষ্টা করছে; এদের পোশাক-খাদ্যরুচি-লাইফ স্টাইল-বাচনিক সক্রিয়তা-সাংস্কৃতিক সূচক; এগুলো মোটামুটি গত দশবছরে সবার চোখের সামনে পরিবর্তিত হয়েছে; ফেসবুক থাকায় এই রূপান্তর বা মেটামরফসিস রীতিমত আর্কাইভড হয়ে আছে। এদের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের গড় সাংস্কৃতিক মানটিও যে কোন সমাজবিজ্ঞানী খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে। দল ক্ষমতায় আসায় উপার্জন বাড়ায়; এরা সেই কাছা মেরে ডানকিনে মাছ ধরা ‘বাতেন’ কিংবা ‘রঞ্জিত’ থেকে আজ এতো সাহেব ও বাবু হয়েছে যে, নুরকে ‘ছোট’ করতে নুরা বলে ডাকছে। তারা কথায় কথায় ঘৃণা প্রকাশ করছে।

একবার এক প্রামাণ্য চিত্র স্যুটিং-এর সময় লক্ষ্য করছিলাম, ইউরোপীয় চিত্রগ্রাহক মন দিয়ে তার কাজ করছিলেন। আর স্যুটিং ইউনিটের দক্ষিণ এশিয় সদস্যরা ‘নর্দমার গন্ধ আসছে’ বলে নাক কুঞ্চিত করছিলেন। এখন ঐ যে একটা শব্দ আজকাল লোকে ব্যবহার করে, এলিটিজম; ওটি সত্যিকার অর্থে ঐ ইউরোপীয় চিত্রগ্রাহকের আছে। তাই তাকে নাক কুঞ্চিত করে এটা দরিদ্র দেশ, এখানে নর্দমার গন্ধ আসে; এটা বড় বড় করে ঘোষণা করতে হয় না।

কিন্তু ‘দক্ষিণ এশিয়রা’ যেহেতু ‘ফইন্নির পুত’ তাদের নতুন এফলুয়েন্স এসেছে; তাই এলিটিজম জানান দিতে তাকে নাসিকা কুঞ্চিত করতে হয়। যেই কোন ব্যাপারে ‘ঘৃণা প্রকাশ’ আসলে ফইন্নির পুতের নিজেকে এলিট প্রমাণের চেষ্টা।

দক্ষিণ এশিয়ার লোকের একটু টাকা-পয়সা হলেই সে নিজেকে ‘আপার কাস্ট’ বলে ভাবতে চেষ্টা করে। কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় ‘অন্য মানুষকে ছোট করে’। সাম্যচিন্তার এই দৈন্যের কারণেই পৃথিবীর অসভ্যতম ধনীদের বাস এখানে; পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষের বাস এখানে।