প্রেমময় উপাখ্যান যেন স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবন

ডিসেম্বর ২১, ২০১৯

প্রতিদিন নিজেকে ধূপের মতো পুড়িয়ে চারপাশে সৌরভ ছড়ানোর কাজটি করে; সন্তুষ্টচিত্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি। এমন আনন্দের মৃত্যুও হয়; নিশ্চিত অমরতার ইনিংস খেলে অপরাজিত ব্যাটসম্যান যেন গ্রিণরুমের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। চারপাশে উচ্ছ্বসিত দর্শকের করতালি; ভালোবাসার উষ্ণতা।

মুক্তিযুদ্ধ যাদের জীবন বদলে দিয়েছে; স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাদের মাঝে উজ্জ্বলতম একজন। একজন স্যুটেড-বুটেড চার্টার্ড একাউনট্যান্ট; দক্ষিণ এশিয়ার মানদণ্ডে স্বীকৃত জীবন; সওদাগরি অফিসে ন’টা-পাঁচটার কাজ; ঝকঝকে ইট ড্রিংক এন্ড ডাই-এর ঝুঁকিহীন জীবন তিনি অর্জন করে ফেলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আগেই।

মুক্তিযুদ্ধে মাটিতে মিশে যাওয়া বাংলাদেশের রক্ত-অশ্রুর পোড়োবাড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; নিজের জন্য বাঁচবেন; নাকি মানুষের জন্য বাঁচবেন! সিলেটের প্রত্যন্তে ২০০ টি গ্রাম পুনর্গঠনের সংকল্প নিয়ে উনি বিলাসি জীবন ফেলে সংগ্রামী জীবনের যাত্রা শুরু করেন।

স্যার আবেদ চার্টার্ড একাউনট্যান্ট থেকে উন্নয়নকর্মী হয়ে গেলেন। উনার এই রূপান্তরটি দেখে মাঝারি চিন্তার সাহেব সমাজটি পাগলামিই বলেছিলো। সওদাগরি অফিসের ঢাউস; ফ্যাশনেবল অফিস কক্ষ ছেড়ে; একটি কাঠের টেবিল; কিছু চেয়ার নিয়ে এই যে উনি অফিস শুরু করলেন; উনার শুভাকাংক্ষীরা একটু দুঃশ্চিন্তাতেই পড়ে গিয়েছিলেন।

স্যার আবেদ বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন। যে জায়গাগুলোতে সরকারের সামর্থ্য সীমিত; সেখানে সরকারের পাশাপাশি কাজ করেছেন তিনি। গ্রামের শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার কমাতে ওরস্যালাইন ও টীকাদান কর্মসূচি নিয়ে কাজ করেছেন। অসচেতন মানুষকে এগুলোর গুরুত্ব বোঝাতে পাঁচ থেকে দশবছর সময় লেগেছে তাঁর। প্রমিথিউসের মতো এক টুকরো আলোর আগুণ নিয়ে গ্রাম-বাংলায় ঘুরেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিশুদের জন্য স্কুল। নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে গ্রামের মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। স্বাস্থ্য-শিক্ষা দুটো ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সম্পূরকভাবে কাজ করেছেন।

বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার স্যার আবেদকে সমর্থন জুগিয়েছে তাঁর কাজে। ভালো কাজের পৃষ্ঠপোষকতা দল-মত নির্বিশেষে সবাই করে; তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন উনি। এক্ষেত্রে উনার বাক-পরিমিতি আর সংকল্পের দৃঢ়তা অবশ্যই সহায়ক হয়েছে।

বাংলাদেশের অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে করতে বিশ্বনাগরিক স্যার আবেদ দারিদ্র্যে বিশীর্ণ পৃথিবীর পথে পথে হেঁটেছেন। পৃথিবীর নানা দেশের পিছিয়ে পড়া সমাজের দিকে সমানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন উনি। উনার গড়া উন্নয়ন সংস্থা অনেক গুলো নাম বদলে এখন ব্র্যাক নামে গোটা পৃথিবীতে এক নামে পরিচিত।

এই যে প্রতিদিন আত্মকেন্দ্রিক সমাজ শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবে ভেবে আলুথালু হয়ে কাটায়; সেইখানে স্যার আবেদ এসব গার্হস্থ্য ক্ষুদ্র চিন্তার গণ্ডি পেরিয়ে অধিকার বঞ্চিত মানুষের জীবন বদলানোর মাঝে আনন্দ খুঁজেছেন। স্যার আবেদের কাছ থেকে আজকের প্রজন্মের এটা শেখা অত্যন্ত জরুরি। অর্থহীন গড়পড়তা জীবন নাকি অর্থপূর্ণ আনন্দদায়ী জীবন ! জীবন অর্থপূর্ণ হয় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে। স্যার আবেদ আসলে বৈষম্যসংকুল বিশ্বের বেদনার জনপদে কাজ করে মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন।

প্রতিদিন নিজেকে ধূপের মতো পুড়িয়ে চারপাশে সৌরভ ছড়ানোর কাজটি করে; সন্তুষ্টচিত্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি। এমন আনন্দের মৃত্যুও হয়; নিশ্চিত অমরতার ইনিংস খেলে অপরাজিত ব্যাটসম্যান যেন গ্রিণরুমের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। চারপাশে উচ্ছ্বসিত দর্শকের করতালি; ভালোবাসার উষ্ণতা।

ইনিংস শেষ করার আগে অনেক ভেবে দেখেছেন স্যার আবেদ; সমাজে সাম্য-সভ্যতা-আনন্দ আনতে সামাজিকভাবে ও আবেগের দিক থেকে মেধাবী মানুষ প্রয়োজন। নিজের জীবনের পুরো অভিজ্ঞতার নির্যাস তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল; যেখানে শিশুরা খেলতে খেলতে শিখবে; কী করে শুধু নিজেকে নিয়ে না ভেবে সবার ভালো নিয়ে ভাবতে হয়; কী করে অন্যের উপকার করা যায়। হিংসা নয়-দ্বেষ নয়-ঘৃণা নয়-লুন্ঠন নয়-অসভ্যতা নয়; মানুষকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসার দীক্ষা রেখে গেলেন স্যার আবেদ। মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসার এক প্রেমময় উপাখ্যান যেন স্যার আবেদের জীবন।

মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক